Monday 30 January 2017

ইমাম শেখকে বিমান বাহিনি পরিবারে স্বাগতম

একদিন ঠিক ঠিক সাবেক ভ্যানচালক ইমাম শেখের সাথে আমার বৈমানিক অগ্রজের নামাঙ্কিত চত্বরে জমিয়ে চা খাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনিকে আমার পরিবারের মত লাগে বললে ভুল হবে, এটা আমার রক্ত সম্পর্কের পরিবার।আমার অগ্রজ ফ্লাইট লে: আইনুল হাবিব (ডাকনাম আপন) ১৯৮৮সালে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে তার সুপারসনিক মিগ ২১ ক্রাশ করে নিহত হয়।কিছুদিন আগে এয়ার মার্শাল (অব) এনামুল বারি বিমান বাহিনি প্রধান থাকাকালিন, বাংলাদেশের প্রথম সুপারসনিক স্কোয়াড্রনের বৈমানিক হিশেবে কর্তব্যকালিন ফ্লাইটে নিহত হবার সম্মানে, আমার অগ্রজের নামে কুর্মিটোলা বিমান ঘাটিতে একটি চত্বর উদ্বোধন করে।
বাবা মায়ের সাথে কিশোর ইমাম শেখ, সাদা শার্ট গায়ে
টুঙ্গিপাড়ার কিশোর ভ্যানচালক ইমাম শেখ প্রধানমন্ত্রির পরিবারকে বহন করবার সুবাদে, প্রধানমন্ত্রির সুপারিশে বিমান বাহিনিতে নিয়োগ পেতে যাচ্ছে।শেষ খবর অনুযায়ি একজন স্কোয়াড্রন লিডার ইমাম শেখের বাড়িতে গিয়ে তাকে নিয়োগপত্র দিয়েছে এবং সাথে করে যশোর বিমানঘাটিতে নিয়ে গেছে।
বিমান বাহিনির অফিসারদের সাথে
সুপারসনিক বিমানের বৈমানিক এমন কি বিমানবাহিনির সব বৈমানিককে করা হয় না।অনেক রকম যোগ্যতা লাগে।আবার সুপারসনিকসহ অন্যান্য বিমানের রক্ষনাবেক্ষনে নন কমিশন এয়ারমেন ছাড়াও অনেক রকম লোকজন লাগে।প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশগত কাঠামোর স্বাস্থ্য ধরে রাখতে বিভিন্ন রকমের নিয়োগের গুরুত্ব কম নয়।বিমান বাহিনির অনেকে বেসামরিক বাংলাদেশ বিমানেও যোগদান করে থাকে। ঠিকমতো রক্ষনাবেক্ষন না হলে উড়ন্ত অবস্থায় কি ঘটতে পারে, তার ভুক্তভোগি প্রধানমন্ত্রি নিজে।

মুহুর্তের খন্ডাংশে সুপারসনিক বৈমানিকদের যে জিবন বাজি রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা ভ্যানচালক, ট্রেনচালক, ট্রাকচালক, বাসচালকদের নিতে হয় না।এ-কারনে বিশ্বজুড়ে সুপারসনিক যুদ্ধবিমানের চালকদের বলা হয় 'টপ গান'।নামের যত বলিহারি থাকুক, শব্দের চেয়ে বেশি গতিতে চলুক আর না চলুক, শেষ অব্দি যুদ্ধবিমান একটি উড়ন্ত আগ্নেয়াস্ত্র বৈ অন্য কিছু নয়।সাধারন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সৈনিক আর উড়ন্ত সেই সুপারসনিক আগ্নেয়াস্ত্র চালানো মেধাবি বৈমানিক, দুজনের কাজই হচ্ছে নৈর্ব্যাক্তিকভাবে মানুষ খুন।আর শান্তির সময়ে এদের কাজ সিমান্ত রক্ষা এবং রাস্ট্রের দর কষাকষির ক্ষ্মতা বাড়ানো।

আদৌ সামারিক বিমানের কোন দরকার আছে কি না তা যেরকম প্রশ্নসাপেক্ষ, আবার এই যুদ্ধবিমান ঘিরে বিভিন্ন খাতের সবচেয়ে মেধাবিদের প্রলুব্ধ করার বিচিত্র কৌশলেরও কোন শেষ নাই।আবার কিছু কিছু মানুষ প্রাকৃতিকভাবে ঝুকিবহুল জিবন যাপনে উন্মুখ থাকে।এই বিতর্কে আমি সেই পরিস্থিতির পক্ষে, যেখানে কার কটা যুদ্ধবিমান আছে সে অনুযায়ি জাতিয় স্বাস্থের পরিমাপ করা হয় না।
নিজের ভ্যানে
   
ভ্যান চালানোও খুব সহজ ব্যাপার নয়, যে চালায় সে বোঝে।সন্ত্রাশি হবার হাতছানি, রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক চাদাবাজ হবার প্রলোভন, মাদকগ্রস্থ হবার আশঙ্কা পার হয়ে কিশোর ইমাম শেখকে শ্রমের মুল্য বুঝতে হয়েছে।সুপারসনিক বানাতে বা কিনতে যে বেশুমার খরচ তার যোগান কড়ায় গন্ডায় দিতে হয় ইমাম শেখদের ভ্যান চালিয়ে, তাদের বাবামায়েদের জমিতে হাল চষে, তাদের ভাইবোনদের গার্মেন্টসে রক্তজল শ্রম দিয়ে।যেসব কুলাঙ্গারেরা আমাদের বোনদের যৌন হেনস্থার পর গলা কেটে হোলি আর্টিজানে হত্যা করেছ, শোলাকিয়ার ইদগাহে আক্রমন চালিয়েছে,  লেখক, প্রকাশকদের হত্যা করেছে, 'ওরা দেখতে কি নিস্পাপ, সুইট' বলে আমরা আদিখ্যেতা করেছি, সেই কুলাঙ্গারদের ডিগনিটির জন্য আমাদের অনেকে ওকালতি করেছে।এই কুলাঙ্গারদের প্রাইভেট পড়াশোনার খরচ ইমাম শেখেরা যোগান দিলেও, ইমাম শেখদের ন্যুনতমো সুযোগ প্রাপ্তিতে আমরা কটাক্ষ করতে ছাড়ি নাই,  কিশোর ইমাম শেখের ডিগনিটি আমরা মনে রাখি নাই।   

আমাদের বেশির ভাগ এখনো বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠির যোগাযোগের অপ্রতুলতা  বুঝে উঠতে পারি নাই।এটা ঠিক যে বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রায় সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন আছে, কিন্তু সেগুলো কিন্তু স্মার্টফোন নয়, আর সারাক্ষন ইন্টারনেট সংযুক্তির জন্য যে স্বচ্ছ বিদ্যুত সর্বরাহ লাগে, তাও বাংলাদেশে নাই।গ্রামের হাটে, বাজারের চাখানাতে যে কিছু জাতিয় পত্রিকা রাখা হয়, তাতে হাটের দিন সবার তা পড়বার সুজোগ হয় না।নামাজের সময়ের জিঙ্গেল দেখানোর ফাক ফোকরে,  চাদের বুকে সাইদির ছবি দেখিয়ে যত সহজে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া যায়, সত্যিকারের তথ্য প্রবাহ সেরকম  নয়।তার ওপর মিডিয়া হাউসগুলো তাদের মালিক কর্পোরেট হাউসের স্বার্থের  সাথে মিস্মার হয়ে যাওয়াতে কোন গুনগত বিভ্রান্তি ছাড়া তথ্য পাওয়া বাংলাদেশে এখন প্রায় অসম্ভব। একজন ইমাম শেখের জন্য টুংগিপাড়া থেকে লন্ডন, প্যারিস যত দুর, যশোর বিমানঘাটিও তত দুর। ইমাম শেখদের বিমান বাহিনিতে নিয়োগের পরিসর যত বাড়বে, তত আমাদের রাজস্ব যাদের কাছ থেকে আসছে তাদের ভেতর ফিরে যাবে।

এই নিয়োগের ইতিবাচক সামাজিক মাত্রাটি লক্ষনিয়।প্রধানমন্ত্রি সুপারিশ করেছে, বিমান বাহিনি একজন স্কোয়াড্রন লিডারকে নিয়োগপত্র হাতে করে পাঠিয়েছে।অর্থাত আশরাফ, আতরাফের উপনিবেশিক প্রোটকল ভেঙ্গে এটা করা হয়েছে।নিয়োগের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এসব প্রোটকল ভেঙ্গে দেয়া দরকার।বিশেষ করে গার্মেন্টস, কৃষি, পরিবহনসহ বিভিন্ন শিল্পে জড়িত তরুন, তরুনিদের হাতেকলমের যাপিত অভিজ্ঞতাকে গিল্ড সনদের মাধ্যমে স্বিকৃতি দিয়ে নিয়োগ প্রতিদ্বন্দিতায় অগ্রাধিকার দেয়াটা সময়ের দাবি।চিকিতসায় স্নাতক শিক্ষার সবচেয়ে বেশি দাবিদার যারা ইতিমধ্যে বেশ কিছুকাল নার্স হিশেবে কাজ করেছে তদের।গার্মেন্টস শিল্পের একেবারে প্রাথমিক পর্জায় থেকে কাজ করে যারা মাধ্যমিক সুপারভাইজার পদে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সরকারি খরচে ব্যাবস্থাপনা শিক্ষায় শিক্ষিত করা দরকার।

গার্মেন্টস শিল্প গঠনের পর সিকি শতাব্দি পেরিয়ে গেলেও হাতেকলমে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গিল্ড সনদের ব্যাবস্থা না করায় সামাজিক কুফলগুলোর ফলাফল আমাদের চারপাশে এখন পত্রপুস্পে মঞ্জরিত।এমন কি কৃষি শিল্পের সাথেও গিল্ড সনদের পর্জায়ক্রমিক ব্যাবস্থা করা হয় নাই।কৃষি শিল্পের ব্যাবস্থাপনার ভার যাদের হাতে, তাদের সাথে এই শিল্পের কোন সরাসরি সম্পর্ক নাই।নিজেদের শিল্পের উচ্চতরো ব্যাবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহনের সুজোগ না থাকায়, এই শ্রমিকেরা সহজেই বিভিন্ন ধ্বংশাত্মক রাজনিতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং সামাজিক ব্যাপক হতাশাজনিত লক্ষনগুলোতে আক্রান্ত হয়।সবচেয়ে দরিদ্র শ্রমিক বস্তিগুলোতে সবচেয়ে বেশি মাদকের ব্যাবসা চলছে।আবার যে দরিদ্র জনগোষ্ঠি তাদের সন্তানদের মাদ্রাসাতে পাঠাচ্ছে, তারা  ধর্মিও সনদ পেলেও, তা কোন প্রায়োগিক শিক্ষায় সংযুক্ত না থাকায় নিয়োগ বৈশম্যের শিকার হচ্ছে!আজকের শিল্পোন্নত দেশগুলো গতকাল তাদের শ্রমিকদের সামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত করেছিল এই অভিজ্ঞতা নির্ভর গিল্ড সনদের মাধ্যমে।

ইমাম শেখের সুযোগ প্রাপ্তিতে যে সমালোচনাগুলো, তার মুল সুরে রয়েছে গেলো, গেলো ধরনের  শ্রেনি বৈশম্যের কায়েমি স্বার্থবোধ।আর যারা কথিত প্রাগ্রসরতার আড়ালে এই সুযোগ প্রাপ্তিকে তির্জকভাবে ব্যাংগ করছে, তারা ঠিকই জানে রক্তাক্ত শ্রেনি বিপ্লবের পরেও একটি সমাজ মাফিয়া চক্রের শিকার হতে পারে, যারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের হাতেই।মৃত ইমাম শেখের সুজোগ প্রাপ্তির দরকার পড়ে না। আর প্রতিটি শিল্পে প্রায়োগিক মেধা-নির্ভর ধাপে, ধাপে গিল্ড সনদের ব্যাবস্থা থাকলে জিবিত ইমাম শেখদের সামাজিক সুজোগ প্রাপ্তির জন্যেও পড়ে পাওয়া ভাগ্যের অনির্দিষ্ট অপেক্ষার দরকার পড়ে না।

ইমাম শেখের ভ্যান রিক্সাটিকে যাদুঘরে নেয়াটা খুব ভাল কাজ হয়েছে।যাদুঘরতো কেবল ঐতিহাসিক মুর্তি দেখানোর জন্য নয়।বরং চলমান বৈশম্যের অর্গলগুলো কোথায় ভাংছে, কোথায় ভাংছে না, কেন ভাংতে পারছে না, সেসব প্রশ্নগুলোর উস্কানি দেয়াটাও যাদুঘরের কাজ।সুপারসনিক বৈমানিকের জন্য যে গৌরব, তার মর্মে পৌছাতে হলেও ভ্যানচালনার ডাইনামিজম বোঝা খুব দরকার।একদিন ঠিক ঠিক ইমাম শেখের সাথে আমার বৈমানিক অগ্রজের নামাঙ্কিত চত্বরে জমিয়ে চা খাওয়া যাবে।আবার ইমাম শেখও হয়ত চাইবে আমাকে তাদের গ্রামটি ঘুরে ঘুরে দেখাতে।টুঙ্গিপাড়া নিয়ে আমার লেখা সনেটটিও সে সুজোগে তাদের উঠানে গলা ছেড়ে পাঠ করে আসবো।সনেট মানেতো ভাই শিকড়ের গান!

চয়ন খায়রুল হাবিব
৩১/০১/১৭
ব্রিটানি