Wednesday 4 January 2017

কয়লাফুলের মৌতাতে, ময়লাফুলের ইকেবানা!

 
কেভিন স্পেইসে, মিনা সুভারি।এমেরিকান বিউটি।
ফুলের মৌতাতে, ফুলের মাস্তিতে আরাধ্য যে কোন বিষয়কে আমি কল্পনা করি ফুলে ভরা বিছানায়, ফুলে ভরা স্নানের চৌবাচ্চায়, এমনকি বিষাদের রোগশয্যাতেও ছিটাতে থাকি বোদলেয়ারের বিপরিতে গুচ্ছ, গুচ্ছ রঙ্গিন, উল্লসিত, আনন্দরুপের ফুল।বোদলেয়ারের মডার্নিটিতে যে প্রতিকি-রোমান্টিসিজম তা গড়াতে, গড়াতে  ঝুমঝুমি বাজাতে থাকে 'এমেরিকান বিউটির' পোস্ট মডার্ন রোমান্টিসিজমে!
কোন ইজমে, কি নামে ডাকা হলো, তাতে ফুলের রুপ, রসের কোন অদলবদল হয় না।কিন্তু ফুলের প্রকৃত সমঝদার, ফুলকে নিজের মত করে ডাকতে চায়, ফোটাতে চায় নিজের স্মৃতির শিকড়ে ভিজিয়ে, নান্দনিক রসোত্তির্নতায়।স্মৃতি সেখানে নাগরিক ভাঙ্গা লিরিকের উদ্বাস্তু সাইকাডেলিয়া!
 
শাহবাগের মোড়ে বেলিফুলের মালা গাথছে রমনিগন!
আশির দশকে যখন কাটাবন, শাহবাগে ফুলের দোকান শুরু হলো, ভাবতাম, এত ময়লাতে এতরকমের ফুলের মালা!তারপর ঘুরেফিরে লন্ডন, প্যারিস, ইস্তাম্বুলের সেরা বাগানগুলো দেখলাম।লন্ডনের কাছাকাছি চেলসি আর হ্যাম্পটন কোর্ট ফ্লাওয়ার শো তো কল্পনাকে হার মানায়, ইস্তাম্বুলের গুলহান বাগানের শুধুমাত্র রুপকথাতেই পরিচয়, আর ভার্সাই হচ্ছে স্বপ্নের ভিতরের স্বপ্ন! 
ঢাকাতেও বিভিন্ন মেয়াদে ঘুরেফিরে আসলাম।যারা একটু মনযোগ দিয়ে রমনা পার্কে হাটাহাটি করেছে, বিচিত্র গাছ গাছালির দিকে তাকিয়েছে, যারা ওয়ারিতে বলদা গার্ডেনের ইতিহাস জানে, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিবেশগত স্থাপত্যকলার ইতিবৃত্ত জানে, তারা জানে ঢাকার প্রানস্পন্দনের ভেতরে মহাপ্রানের ইকেবানা লুকিয়ে আছে।কিন্তু ঢাকাতে ফুলের পাহাড়ের পাশে ময়লার পাহাড় বেড়েই চলেছে, দুর্গন্ধ, সুগন্ধের মিস্মার  চিড়িয়াখানা অবস্থা!
 
আমার ব্যালকনি, আমার লেখার জায়গা!
ওয়াইন সম্পর্কে জানা, রান্নাবান্না নিয়ে গবেষনার বাইরে ঘরোয়া ছোট গাছের পরিচর্জা আমার আরেক  শখ!ক্যাকটাসগুলা কেনা, তা বাদে বিবিধ পাতাবাহার পৌর আইল্যান্ড থেকে চুরি করা।ফ্রান্সের পশ্চিম উপকুলের ব্রিটানি অঞ্চলের যে ভ্যান শহরে থাকি তিন মাস পরপর মৌসুম অনুযায়ি তার রুপসজ্জা বদলে ফেলা হয়।এই রদবদলের কেন্দ্রে থাকে পোর্ট সাইডে খোলাকাশের নিচে আর কিয়স্কে একটা বড় প্রদর্শনি, আর শহরের সবখানে আইল্যান্ডের মাটির বিছানায় বিচিত্র ছোট গাছের নবায়ন।
বছর, বছর এই স্থাপত্য এবং বোটানিকাল রুপসজ্জা নিয়ে ফ্রান্সের শহরগুলোতে জাতিয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দিতা হয়।আমিও তক্কে তক্কে থাকি।মৌসুম শেষের ফেলনা গাছগুলোর কোনটা পছন্দ হলে তা পলিব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে আসি।বাহিরটাকে ধারন করি অন্দরে।টবের মাটি তৈরি ইত্যাদি থেকে বুঝি ময়লা ছাড়া ফুল হয় না!ময়লাটাই সার।বস্তির আতরাফদের ছাড়া যেরকম ঢাকার আশরাফদের চলেনা।বস্তির আতরাফিতেই ঢাকাই আতরের মুল নির্জাস।

''কিন্তু ঐ পাপড়িদের ঐ রেনুকনাদের একক চেহারা কোথায়
এ-প্রশ্নটা সুধালোই বা কে ভিড়ের ভেতর
আর সুধিয়েই হারালো কেনো চেহারাবিহিনতায়
এসব হেয়ালির উত্তরে কে বলেছিল ফুলেরাই ব্যক্তিত্ব"

আমার নিজের অনেক জমি থাকলে সুর্জমুখির চাষ করতাম!মাটি কর্শন, বিজ রোপন থেকে শুরু করে সুর্জমুখির বিজ মাড়াই করে সুর্জমুখির তেল ভরা পিপার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইতাম ভিন্সেন্ট ভ্যান গগের মনের অবস্থা।এরকম ফুল পাগল এবং ফুলের ভেতরেও সুর্জমুখি তন্ময় শিল্পি আর দেখা যায় নাই!পল গগ্যা, রেনোয়া এবং আরো অনেকের ফুল নিয়ে কাজ আছে, কিন্তু ভ্যান গগের মত এরকম সুর্জমুখি কাতর শিল্পি আর পাওয়া যায় নাই।
 
  পল গগ্যার আকা ভ্যান গগের প্রতিকৃতি, গগ্যা যার নাম দিয়েছিল, 'সুর্জমুখি ফুলের আকিয়ে', ১৮৮৮


পল গগ্যা নিজেও গাছ, গাছালির বর্নালিতে বিভোর থাকতো, বেশির ভাগ সময় কাটাত তাহিতিতে, আর ফ্রান্সে ফিরলে বিশেষ এক রহস্যময় গোধুলির টানে চলে আসতো ব্রিটানিতে।সেই গগ্যা, একসময় ভ্যান গগের নিমন্ত্রনে তার সাথে থেকে কাজ করতে গিয়েছিল ফ্রান্সের আরলে অঞ্চলে।ভ্যান গগের ইচ্ছা গগ্যার সাথে মিলে আর্লেতে একটা আর্ট কলোনি গড়বে।কিন্তু কিছুদিন পরপর ভ্যান গগ মানষিক ভাবে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ঝগড়া বেধে যাচ্ছে গগ্যার সাথে, যার এক পর্জায়ে গগ্যার থাকাকালিন ভ্যান গগ নিজের এক কান পুরো কেটে ফেলে।এসময় গগ্যা ভ্যান গগের একটা প্রতিকৃতি আকে, যাতে ফুলদানি ভরা সুর্জমুখি গুচ্ছের দিকে তাকিয়ে ভ্যান গগ ইজেলে সুর্জমুখি আকছে।গগ্যা তেলচিত্রটার নাম দিয়েছিল, 'সুর্জমুখি ফুলের আকিয়ে' The Painter of Sunflowers (in French: Le Peintre de Tournesols)। গগ্যার আকা প্রতিকৃতি দেখে ভ্যান গগ প্রথমে ক্ষেপে গিয়েছিল যে গগ্যা তাকে উন্মাদ হিসেবে একেছে!পরে ভ্যান গগ নরম হয়ে আসে, গগ্যাকে বলে, ''একেবারে আমি যেরকম সেরকম হয়েছে, প্রচন্ড ক্লান্ত এবং ইলেক্ট্রিকে আক্রান্ত!''

 ''বাইরের পাপড়িরা পোড়ায় ভেতরের পাপড়িদের
বিজ় ফাটার শব্দ ধরে ধরে আমরা আগাই
শব্দরাই তৈরি করে সুর্যমুখিদের বিষদ বিস্তার
বিষদে যেতে যেতে ভিনসেন্ট ভাঙ্গে ফুলদানির নিষাদে''

ভ্যান গগকে নিয়ে এলিজি লিখেছিলাম নিজের প্রক্ষিপ্ততাকে বাধতে।যত প্রবেশ করছিলাম ওর ইম্প্রেশানিস্ট জগতে, তত পরতের পর পরত খুলে যাচ্ছিল ফুলের শিল্প, শিল্পের ভাষা, ভাষার গল্প, গল্পের মেটাফোর, বিমুর্ততার পেছনের সবচেয়ে মুর্ত মৌল রুমাল।আমি আমার মুখোমুখি হচ্ছিলাম।কবিতাটি পড়ে, দেখে ভ্যান গগ আমার কানে ফিশফিশিয়ে বলেছিল, ''হ্যা ঠিক এরকমটাই, একেবারে হবহু এরকম প্রচন্ড ক্লান্ত এবং ইলেক্ট্রিকে আক্রান্ত!''

ইস্তাম্বুলের গুলহান বাগান

ভাবতে অবাক লাগে, যে ইস্তাম্বুল শহরে গুলহানের মত আশ্চর্জ বাগান, সেখানে ঘটে চলেছে একের পর এক নৃশংস মারনযজ্ঞ!যে ঢাকাই নবাবদের প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্টের মুলমন্ত্র ছিল সংলগ্ন বাগান ও পরিবেশের বিকাশ, সেখানে দুই প্রজন্ম না ঘুরতেই মানুষের প্রানের মুল্য এখন নদির বালুর চেয়ে কম, আর নদির প্রানভোমরা বন্দি ডেভেলপারের হালখাতায়!

ঢাকাতে বিয়েতে, প্রভাত ফেরিতে এবং আরো হরেক উপলক্ষ্যে কোটি টকার ফুল বিক্রি হয়।ফুলের দোকানগুলোতে যেসব ঢাউস এলবাম থাকে তাতে সাজ বুঝে হাজার থেকে লাখ টাকার মেনু বাধা।শুধু শাহবাগ, কাটাবন এলাকার ফুল বিক্রির কর ঠিকমত আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরিচর্জা সম্ভব।মন্দের ভালর মত বিভিন্ন পার্বনে মাথায় ফুলের মুকুট পরা মেয়েগুলোকে দেখলে মনে হয় শ্যামলা-ভেনাস, মন জুড়ায়ে যায়।

এই লাখেরাজ, স্বপ্নবাজ পরিবেশেও কুটিল দানবিয়তা একোনায়, ওকোনায় ঘাপ্টি মেরে থাকে।সুগন্ধ, দুর্গন্ধের মনস্তাত্বিক   ভজঘটে কি না জানি না, শুধু ঢাকাতে না, পুরো বাংলাদেশে ছেলেদের একটা মারমুখো অবস্থা।যেটুকু শিক্ষিত হলে ফুলের নন্দন উপলব্ধি করতে পারবে তা নেই, কিন্তু যে দক্ষতাটুকু হলে ফুল কিনতে পারবে তা অনেক ছেলে অর্জন করেছে।আর মেয়েদের মারমুখিতা তৈরি হয়েছে তাড়া খেতে খেতে, অবিচারের একমুখি ভোগ্যপন্যে রুপান্তরকে রুখে দাড়াতে, দাড়াতে।ফুলের দোকানে মালা গাথে মেয়েরা আর শিশুরা, টাকা গোনে বয়স্ক পুরুষেরা। 

কুয়ার ব্যাংগুলো বলে বিদেশি এটা বন্ধ করতে হবে, ওটা আনা যাবে না, সেটা দেয়া যাবে না!ফুলের কি দেশি বিদেশি আছে?দেশিটা কতটুকু দেশি?আজিম্পুরের বাসার লাগোয়া বাগানের রক্তজবার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম এটাই বাংলাদেশের দেশি ফুল।তারপর চ্যানেল পারের মাইক্রো ক্লাইমেট দ্বিপগুলোতে ঘুরে পেলাম কতরকমের, কত বর্নের জবাফুল!পল গগ্যার আকা দুর প্রশান্ত মহাসাগরিও তাহিতি দ্বিপের ছেলেমেয়েদের কানে, গলায় যেসব ফুলের ছবি, তাও কি আমাদের দেশি ফুলের সাজুজ্য বহন করে না?

''রক্তজবারা বিচিত্র নিজেদের রক্তাক্ততায়
রজনীগন্ধারা পবিত্র রাতের নির্লিপ্ততায়
শেফালিরা মুগ্ধ নজরুলের গানের সুরে
কদমেরা হতবাক গ্রীস্মের তাণ্ডবিতণ্ডায়''

ফুলের মৌতাতে, ফুলের মাস্তিতে চুর হয়ে আছি সেই মাতৃগর্ভ থেকে।আত্মজৈবনিক ''গরম কাদার ক্যাণ্টো'' লিখি, আর সনেট সিরিজে বেধে ''রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছের'' অর্কেস্ট্রা সাজাই, ফুলের সংসার তার সমস্ত ঐতিহাসিক রেনুকনা নিয়ে আমার মগজকে অবস করে দেয়, আমার হৃতপিন্ডের ধুকপুক বাড়িয়ে দেয়।এটুকু যে পড়েছে, সে হয়ত মনে মনে টিপ্পনি কাটছে, রবীন্দ্রনাথের ভাবে পেয়েছে ওনাকে।সেতো একেবারে সুদাসলে, ফুলপাগল বুড়ামিয়ার সাথে  আত্মিয়তাও সেই মাতৃজরায়ু থেকে।
 
বলদা বাগানে বিজ্ঞপ্তি।ব্লগার 'গরম কফি'র সৌজন্যে
ফুল আর প্রেম সহদর, ফুলের রেনুর টানে ছুটে আসে মৌমাছি, এভাবেই ঘটে প্রকৃতির পরাগায়ন।মাইকেল, প্রেমিক যুগলের নান্দনিক নাম দিয়েছিল কপোত-কপোতি।খোলা আকাশের নিচে পার্কে, উদ্যানে, বাগানে প্রেমিক, প্রেমিকারা ঘনিষ্ঠ হবে সেটাই স্বাভাবিক।রমনা পার্কে, বোটানিকাল গার্ডেনে, বলদা বাগানে, চন্দ্রিমা উদ্যানে, শালবন বিহারে কোন কপোত-কপোতি কারো চেয়ে বেশি তপ্ত হবে সেটাও স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক।একটা শহরের উদ্যানে, বাগানে যত বেশি প্রেমিক যুগলকে, যত বেশি ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যাবে সে শহরের মানষিক স্বাস্থ্য তত ভাল হয়ে ওঠে।
বলদা বাগানে কপোত কপোতিরা।ব্লগার 'গরম কফি'র সৌজন্যে
ফুলের বিক্রি বাড়লেও, প্রেমের স্বাস্থ্যহানি বোঝা যায় তনুর হত্যাকান্ডে, খাদিজার ওপর বর্বর আগ্রাসনে।প্রেমিক যুগলদের কিভাবে হেনস্থা করা যায়, কিভাবে বেকায়দায় ফেলে চাদা আদায় করা যায় সে উদ্যেস্যে পার্কে, বাগানে ছেলের দঙ্গল ঘুরে বেড়ায়।আবার নিজে প্রেমিকাকে ফুল দিয়ে এসে বাসাতে হেনস্থা করে বোনকে, আইনরক্ষাকারি বাহিনিও নানা ছুতায় বাংলাদেশে প্রেমকে পিশে থেতলে ফেলতে চায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা অভিযুক্ত হয় ছাত্রি নির্জাতনে।ফুলের বাজারে প্রেম বিরোধিতার অর্গলকে অনর্গল করতেই য্যানো ভালবাসা দিবস!

ভালবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ইদুল ফিতর, জন্মাস্টমি, দুর্গাপুজা, বৌদ্ধ পুর্নিমা, নিউ ইয়ার্স ইভ মিলায়েই বাংলাদেশের বিশ্বায়িত ইকেবানা।একেকটা উদযাপন একেকটা ফুলের পাপড়ি।যে পাপড়ি ঝরে গেছে কোটি বছর আগে, আজকে তা কয়লাফুল।ফুলের শিকড়ে যে ময়লা সারটুকু তা বেয়ে বেয়ে উঠছে আগামিকালের রসোত্তির্ন কবিতায়!

চারপাশ থেকে ছুয়ে দিচ্ছে কয়লাফুলের ফ্যানা, ময়লাফুলের সুবাস।বস্রাই গোলাপের রক্তাভা এক চৌবাচ্চায় আমাকে ডাকছে হাজার হাজার সাইরেন। 

চয়ন খায়রুল হাবিব
৪/১২/১৭ দিবাগত রাতভর
ব্রিটানি