Tuesday 11 October 2016

শিব্যলেথ : মহাফাটলের উপকথা


লন্ডনের টেট মডার্ন শিল্পশালার ‘টারবাইন হল”-এর মেঝে জুড়ে এ-মাথা থেকে ও-মাথা অব্দি এক লম্বা আঁকাবাকা ফাটল।দরিস সালসেদোর (Doris Salcedo, born 1958) খোঁড়া এ-ফাটল শুধু যে কংক্রিটের মেঝেতে চিড় ধরিয়েছে তাই নয়, এ-ফাটল এক টানে টেট-এর ভিত্তিমূলে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।

দরিস সালসেদো জন্মেছিলেন কলম্বিয়ার বোগোটা শহরে ১৯৫৮ সালে। ফাইন আর্টস পড়াশোনা করেন বোগোটা আর নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। গেরস্থালির পরিত্যক্ত, ভাঙাচোরা চেয়ার, টেবিল, খাট, জানলা, দরজা ইত্যকার আসবাবপত্র একটার সাথে আরেকটা খ্যাপা-বেখাপ্যা ভাবে জুড়িয়ে তৈরি তার ভাস্কর্যগুলো আশি ও নব্বই দশকে লন্ডনে সাড়া জাগায়। সে সূত্রেই এ-বছরের শেষ থেকে আগামি বছরের শুরু অব্দি টেট-এ আয়জিত The World As A Stage প্রদর্শনীতে তার আমন্ত্রণ।

অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি মতে Shibboleth শব্দের অর্থ হচ্ছে : উচ্চারণ রীতির ব্যবহার করে লোকজনের আঞ্চলিকতা নির্ণয়। এমন একটা শব্দ বলতে বিদেশীদের বাধ্য করা যা উচ্চারণ করা শুধু দুষ্করই নয়, অসম্ভব। শিব্যলেথ হচ্ছে এক সম্প্রদায়ের সাথে আরেক সম্প্রদায়ের সম্পর্কে ভাঙন ধরানোর শাব্দিক কৌশল

মাতিস-জ্যোতি এবং প্যাট্রিসিয়া। সালসেদোর শিব্যলেথ ফাটলের ওপর। 
টেট মডার্ন, ২০০৭।

বাইবেলের এক ঘটনায় প্রথম শিব্যলেথের উল্লেখ পাওয়া যায়। এফ্রামাইট সম্প্রদায় জর্দান নদী পার হয়ে পালাবার সময় শত্র“-সম্প্রদায় গিলিয়াডাইট তাদের পথরোধ করে। দুই সম্প্রদায়ের ভাষা এক হলেও এফ্রামাইটেরা “শ” উচ্চারণে অপারগ। শিব্যলেথ উচ্চারণে ব্যর্থ হলেই তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড। বয়স ও লিঙ্গভেদে কোনো ছাড় নেই। শিব্যলেথ হচ্ছে ক্ষমতার প্রতীক। কিন্তু ২০০৭ সালের এক শিল্পশালায় এ-শব্দের তাৎপর্য কী?

সালসেদো তার খোঁড়া ফাটলের নাম দিয়েছেন ‘শিব্যলেথ’। তার দাবি ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্ব সম্পূরক। তিনি দেখতে চান ফাটলটিকে ঘিরে, ফাটলটির কিনার ধরে দর্শকেরা আদৌ কিছু করতে চান কিনা?
সালসেদো তার ফাটল সম্পর্কে বলেন, উপনিবেশবাদের ইতিহাস সবসসময় বর্ণবাদের ইতিহাসকে পাশ কাটাতে চেয়েছে। আর তা থেকেই ধনী, গরিবের; উত্তর দক্ষিণের ফাটল।


আশির দশকে ঢাকায় আমি কিছুকাল শিব্যলেথ-পূজারীদের কঠিন পাল্লায় পড়েছিলাম। তখন এরশাদীয় স্বৈরতন্ত্রের মাঝ পর্যায়। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বসে আছি। ঢাবি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। ক্যাম্পাস বাসার কাছে হওয়ায় আর জমজ বোন দুবছর আগে ম্যাট্রিকের পর থেকে আর্ট কলেজের ছাত্রী হবার সুবাদে বেশির ভাগ সময় কাটত টিএসসি কিম্বা আর্ট কলেজে। নাট্য আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহিলা সমিতি পর্যন্ত অবশ্যই; তাছাড়া পুরো বাংলাদেশে উচ্চারণরীতি ভেদে শ্রেণিক্ষমতার প্রভাব টের পাই। এ-ব্যাপারটি আমি চোস্ত শুদ্ধ বাংলা বলা ঢাকাইয়া খান্দান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শামসুর রাহমানের সাথে আলাপ করেছি অনেকবার। দুজনেই পুরান ঢাকার ‘অয় তর মা কা বাপ…’ উহ্য রেখে যা বলতেন তার সার হচ্ছে : শিব্যলেথ ঘুরিয়ে মারবার কায়দাই হচ্ছে সাহিত্যের কারবার।


টেট-এর টারবাইন হলে কোনো স্থাপনার বদলে একে খুঁড়তে চাইলেন কেন সালসেদো? এই সৃজনশীল নাশকতার উস্কানি টেট-এর ইতিহাসেই লুকিয়ে ছিল। ১৯৪৭-এ মহাযুদ্ধ পরবর্তী লন্ডনের জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য বানানো হয়েছিল বিশাল এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র। উপনিবেশের ভাঙা হাট থেকে ছিটকে আসা সৈনিকেরা আর নতুন কল্যাণকামী রাষ্ট্রে ভিড় করা নানা জাতের, নানা ভাষার, নানা বর্ণের মানুষেরা চাইল শান্তি, সহাবস্থান আর জীবিকা। লন্ডনের ওই বিপুল বিশ্বজনতা চার্চিলকে বীরের মালা পরিয়ে দিলেও তাকে কিন্তু ভোটে জেতালো না। লেবার পার্টির তত্ত্বাবধানে শুরু হোল বহুমাত্রিক-সংস্কৃতির যাত্রা। কিন্তু বর্ণবাদের বিষ থেকে থেকেই এই যাত্রাকে ছোবল দিতে না পারলেও ফণা তুলে ভয় দেখাতে চেয়েছে। বর্ণবাদের সাথে এখন মিশেছে মৌলবাদ। 

১৯৮১-তে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে বন্ধ হবার পর টারবাইন হল এখন শিল্পশালার স্বাগত কক্ষ। একে খুঁড়ে লন্ডনের ইতিহাসকে খুঁড়লেন সালসেদো। খুঁড়েই ক্ষান্ত নন। বললেন, টেট মডার্ন যে মডার্ন আর্টের সংগ্রহশালা…এই মডার্ন আর্ট যে মানবিক আদর্শের ওকালতি করছে; সে-আদর্শের মূলে ইউরোপিও ধ্র“পদ সংস্কৃতির প্রভাব এত একতরফা যে ইঊরোপের বাইরের লোকের পক্ষে এর সাথে চাইলেও সঠিকভাবে তাল মেলানো মুশকিল। শিল্প শাশ্বত, কিন্তু শিল্পীর সব কথাই কি বেদবাক্য?

আমার বাবা জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ডাকাতিয়া নদীঘেষা এক গ্রামে। শ্বেতাঙ্গিনীর গর্ভে আমার ছেলে মাতিস-জ্যোতির জন্ম ফ্রান্সের ব্রিটানি প্রদেশের এক ছোট্ট গ্রামে। সালসেদোর ফাটল আমাকে ভাবায়, আমাকে নাশকতার উস্কানি দেয়। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। মাতিস সুধোয়, ‘বাবা ওটা কি সত্যি সত্যি ফাটল?’
আমি বলি, ‘না, ওটা খেলনা ফাটল।’
‘তাহলে আমি ওই ফাটলে ঢুকতে চাই।’
চমকে মাতিসের হাত ধরে ফেলি। তারপর আবার ছেড়ে দেই।
খেলনা ফাটলের তল থেকে কি খেলনা ভূমিকম্পের গুরগুর আওয়াজ ভেসে আসে?

চয়ন খায়রুল হাবিব
লন্ডন ,নভেম্বর ২০০৭

আলোকচিত্র : চয়ন খায়রুল হাবিব