Friday 16 September 2016

নাট্যভাবনা

নবায়নের দিক থেকে বলতে গেলে আমাদের নাট্যসাহিত্য, মঞ্চনাটক, টেলিনাটক এক মহাদুরবস্থায় অধপতিত।নাট্যসাহিত্যের তেমন একটা প্রকাশনাগত চর্চা আর নাই, যারা চর্চা চালাতে চায় তারা মঞ্চনাটক প্রায় দেখেন না।মঞ্চকর্মিরা, টেলিশিল্পিরা নাট্যসাহিত্য তেমন একটা পড়েন না।
যেসব মঞ্চকর্মি নাট্যতত্ব, পার্ফর্মেন্স আর্টস ইত্যাদি পড়েন, তারা কি পড়েন?তারা পাশের পড়ার মত পড়েন মনসামঙ্গল, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি।বলছি অনুশিলিত পাঠের এবং প্রয়োগের নবায়নের কথা।সৈয়দ হক, সেলিম আল দিন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশিদ পাঠ অবশ্যই জরুরি।কিন্তু সে-পাঠও হচ্ছে তাদের পেছনে সঙ্ঘ ছিলো এবং আছে বলে।সঙ্ঘের অধিপতিরা ঠিক করে দিচ্ছে নাট্যকর্মি কি পাঠ করবে।

'ডৌলঃ জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকে জুলাখা চরিত্রে পারভিন পারু ও জেরাকারি জুনাইদ ইউসুফ

অর্ধশতক ধরে আমরা মান্ধাতার মঞ্চায়নের পাশাপাশি ব্যার্থ সাংবাদিকতা, ব্যার্থ শিক্ষকতা, ব্যার্থ রাজনিতি, ব্যার্থ আমলাতন্ত্রের যোয়াল মঞ্চের উপর কমিট্মেন্টের নামে চাপিয়ে দিয়েছি।রাজনিতির কর্মি যে পরিচ্ছন্ন বা নোংরা রাজনিতি করে করে ওপরে উঠে; কিম্বা সার্থক আমলা যে সমস্ত কুটচালের মাধ্যমে সফল বা বিফল হয়, মঞ্চনাটক যদি সেই একই রাজনিতির চর্চিত জায়গা হয়, তাহলে মঞ্চ কিভাবে আরেকটি নতুন বা বিকল্প বা ব্যাক্তিক দৃষ্টিকোন দেবে তা আমার বোধগম্য নয়।আবার রাজনৈতিক কর্মিরও তখন নাটকের দর্শক হবার ইচ্ছা অবলুপ্ত হবে, কারন ঘুরেফিরে যে পচন সে তার মননে ধারন করে, মঞ্চ তার অংশ হয়ে যায়।

সাহিত্যে যেরকম কবিতা, গল্প, নাটক, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস আলাদা, সেরকম ব্যালে, নাটক, অপেরা, যাত্রা, সিনেমা এগুলো প্রত্যেকটা স্বার্বভৌম মাধ্যম। কলাকৈবল্যবাদকে পাশ কাটালেও শিল্প এবং শিল্পোত্তির্নতা এ মাধ্যমগুলোর অন্যতমো প্রধান শর্ত!অন্য আরো শর্ত আসতে পয়ারে অস্থি, মজ্জা, রক্ত, মাংসের মত; কিন্তু মগজ ও হৃতপিন্ড দুজায়গাতেই শিল্পশর্তের অগ্রাধিকার।সে জায়গাতে সঙ্ঘের, মতবাদের, মুনাফার এমন কি কথিত অংগিকারেরও অগ্রাধিকার চলে আসলে তা মাধ্যম হিশেবে অন্য কিছুর পুজারি, শিল্পদেবির আশির্বাদ ও অভিসম্পাতের বাইরের অন্যকিছু।সমকালিন বিশ্ব সাহিত্যের দুই আচার্জ ফরাসি নাট্যকার জা পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ মার্ক্সবাদি জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ড ব্রেখট ঘিরে অনুসারিদের বিতন্ডা এক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য!

ডৌলঃ জুলেখার জেরা পর্ব নাটকের মহড়া
মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ মায় আর যাদের নাম নিলাম তাদের কেউ কিন্তু পার্ফমিং আর্টসের আনুষ্ঠানিক ছাত্র নন; কিন্তু তাদের দেশি, বিদেশি নাট্যসাহিত্য পাঠের পরিধি বোঝা যায় তাদের নাটকের সংলাপের বহুসচলতায়।বিশ্বের জাদরেল নাট্যকারেরা বড় মাপের কবিও বটে।বাংলা আধুনিক নাটকের সুত্রপাত দুই মহাকবি মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথের হাতে; ভারতিয় ভাষার আদি নাট্যগুরু হচ্ছেন মহাকবি কালিদাশ!বাংলাদেশের স্বাধিনতার পর কি শুধু একজন কবি সৈয়দ শামসুল হক কবিতার বাইরে নাটক লিখেছেন?না কি অন্য কবিদের নাটক লেখার খবর নিতে মঞ্চের অধিপতিরা কুন্ঠা বোধ করেছেন?কুন্ঠা হোক, ইর্শা হোক, পিঠে ছুরি মারা হোক, নিরেট অজ্ঞ্বতা হোক সমকালিন সহিত্যের সাথে মঞ্চের, টেলির যে একটা মারাত্মক দুরত্ব তৈরি হয়েছে এবং তার কুফল যে পত্রে, পুস্পে মঞ্জরিত হয়ে আমাদের নান্দনিকতাকে গ্রাস করতে উদ্যত তার ডায়াগনোসিস অস্বিকার করলে, পথ্য নির্দেশনাতে ঘাটতি বাড়বে বৈ কমবে না।বার বার একজন হুমায়ুন আহমেদকে দেখিয়ে পরম্পরাগত নান্দনিক ঘাটতি বরং আরো বাড়বে।

ভিডিও ক্যামেরা হাতে আসলেই আমরা টেলিফিল্মমেকার; মোবাইলে টেক্সট করতে পারলেই কবিদের লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতিচিহ্নছাড়া নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু আবুল হাসানের মত মেজর কবির অগ্রন্থিত নাটক প্রকাশিত হবার পরও মঞ্চায়নের উদ্যগ নিচ্ছি না!টেলিনাটকের সংলাপের যে দুরবস্থা তাতে নিসন্দেহে সাহিত্য থেকে এর নেবার আছে তা পাল্প ফিকশান পর্জায়ে হোক বা উচ্চতরো কাব্যিক নান্দনিকতার জায়গা থেকে হোক!

একজন কবি মুস্তফা আনোয়ার একজন দুর্দান্ত নাট্যকারও বটে।মুস্তফা স্বাধিন বাংলা বেতারের একজন সংগঠক ছিলেন এবং নব্বইয়ে অবসর নেবার আগে বাংলাদেশ বেতারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিলেন।মুস্তফার স্ত্রি নাজমা আনোয়ার মঞ্চে ও টেলি নাটকে সক্রিয় ছিলেন দির্ঘদিন।নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়, গনমাধ্যমে উচু পদ, স্ত্রির জনপ্রিয়তা কোনটাকে মুস্তফা তার সাহিত্য প্রমোটে ব্যাবহার করেন নাই।সেই প্রমোশানের সুবাদে তার শাক্তিশালি রবীন্দ্র বিনির্মিতি 'কোন ডাকঘর নেই' যদি বাংলাদেশের মঞ্চে আসতো তাকে অন্তত আমি ক্ষ্মতার অপব্যাবহার বলে গন্য করতাম না।লোকগাথা, বিরগাথার আধিক্যের পাশে আমাদের মনস্তাত্বিক নাটকের ভান্ডার শুন্য।মুস্তফার মত অপরাপর কবিদের নাট্যচর্চার খোজ নিলে আমাদের সে শুন্যতা কিছুটা হলেও কমতো।

'ডৌলঃ জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকের প্রিমিয়ার শেষে নাট্যজন সারা জাকেরের(বা থেকে দ্বিতিয়) সাথে বা থেকে জুনাইদ ইউসুফ, পারভিন পারু, শিশির রহমান ও চয়ন খায়রুল হাবিব 
ঘটনাচক্রে আমাদের অনেক কবি, সাহিত্যিকের স্ত্রি, কন্যা মঞ্চে, টেলিতে যুক্ত; কিন্তু সেখানে তাদেরকে কাজ পেতে হয়, টিকে থাকতে হয় অধিপতিদের স্তুবগান করে।আবার যেসব জায়া, কন্যাগন নিজেরা অধিপতি হচ্ছেন, তারাও চান একচ্ছত্রতার স্তবগান।স্তুতিচক্র ভেদ করে সরস্বতির প্রবেশ যে শুধু দুসাধ্য তাই নয়, অবস্থা বিশেষে তা স্বাগত নয়!মঞ্চাধিপতিরুপি পুরুষ ও মহিলাদের স্বৈরাচারের পাশে যুক্ত হয়েছে, নাট্যতত্ব এবং পার্ফন্মেস আর্টস শিক্ষকদের তত্বিয় মামদোবাজি!আর সে মামদোবাজির মামদোভৌতিক-যাতাকলে মৌলিক সৃজনশিলতা খর্ব করে যে কিম্ভুত, অদ্ভুত তৈরি হয় কোন দর্পনে তার স্বরুপ দেখতে মঞ্চ ও টেলিশিল্পিরা রাজি নয়!সাহিত্য বিমুখতার একটা বড় কারন এখানেও যে সাহিত্য আত্মসমালোচনার দর্পন তৈরি করে!

সরস্বতি ও লক্ষির বিবাদভঞ্জনে একজন উচুপদের আমলা সাইদ আহমেদকে যখন মঞ্চাধিপতিরা গুরুতরো নাট্যজন বানিয়ে দেন, কিম্বা আরেকজন উচু পদের আমলা মুস্তফা আনোয়ারকে দেখেও না দেখার ভান করেন, তখন আমরা যে সাইদ আহমেদকে পাই এবং যে মুস্তফা আুনোয়ারকে পাই না, তার ভেতর গুনগত কোন পার্থক্য থাকেনা।পাওয়াটা আমাদের না-পাওয়ার চেয়ে বড় শুভঙ্করের ফাকি হয়ে দাঁড়ায়!

এই ফাকির উপর দাড়িয়ে যখন একজন বাংলাভাষি কবি, সাহিত্যিক যখন একটি নতুন নাটক লেখেন তা যেরকম অভিনন্দনযোগ্য, সেরকম সে নাটকের পাঠকের, দর্শকের প্র্য়াসও সমান অভিনন্দনযোগ্য।

চয়ন খায়রুল হাবিব
১৬/০৯/১৬
ব্রিটানি