আমার সারাজিবনের কাব্যপ্রতিমা জুলেখা।উনিশ বছর বয়সে প্রথম 'জুলেখা সিরাপ' কবিতা লেখার
পর গত দশ বছর ধরে জুলেখাকে ঘিরে একটা ট্রিলজি-কাব্যনাটক লিখছি যার দুটো প্রকাশ হয়েছে।
একজন ইনবক্সে জুলেখাকে বল্লো, 'কাজের বুয়া'!তার দেয়াল আবার কমার্শিয়াল-ছেমরিতে ভরপুর!
গৃহবধুরা যদি কমার্শিয়াল-ভ্যাম্পিশনেস প্রবনতার পাশাপাশি 'কাজের বুয়াদের' যথার্থ মর্জাদা দিতো,
তাহলে 'কাজের বুয়া'টা তাদের ছেলেমেয়ে, স্বামিগন গালমন্দ অর্থে ইনবক্সে ব্যাবহার করতে দুইবার
ভাবতো।
আমার কৈশোরে, যৌবনে 'বাবুর মা' 'বাবুর দাদি' আমাদের বাসাতে কাজ করতো, যাদের নাম আমার
কখনো জানা হয় নাই।বাবুর মায়ের রান্না আমার কাছে দুনিয়ার তাবত রান্নার মানদন্ড, এত অল্প
ব্যাঞ্জনে এত ভাল রান্না আমি আর খাই নাই।নিজের রান্না ভাল হলে, মনে মনে বলি 'বাবুর মা'র মত
হলো।'কুট্টি শব্দটার পেছনে ঢাকাইয়াদের দারিদ্র ও সংগ্রামের কাহিনি লুকানোঃ ঢাকা জুড়ে ধানের
আবাদ গোলাতে ওঠানোর আগে যারা আসপাশের এলাকা থেকে ধান কুটতে আসতো এবং পরে
জমিতে পড়ে থাকা ধান কুড়াতো তারাই পরে কুট্টি হিসাবে ঢাকাতে থেকে গেছে; ঢাকার স্থানিয়
এল্কোহলের নাম ধানকাট্টিও একই কারনে; আর আছে দিল্লি থেকে আসা তুর্কি খানদানের অধস্তন
কুলি, চাপরাশিরা।বাবুর মা আমার কাছে ঢাকেশ্বরির প্রতিমাও।
এক কাপড়ে গায়ে গোসল ব্যাপারটা এবং তার আসপাশে ঢাকাইয়াদের নিরব-সম্ভ্রমবোধ
আগাপাশতলা পুরান ঢাকাতে বড় না হলে বোঝা অসম্ভব।বাবুর মা সব কাজের শেষে যে শাড়িতে
কাজে আসতো, সে শাড়িতে গোসল করে, ভিজা শাড়িতে বাড়ি ফিরে যেত চরে, পথে পরনেই
শুকিয়ে নিত শাড়ি, বাদলার দিনে বৃষ্টিতে সেরে নিত গোসল।সেই সমত্থ,জোয়ান বাবুর মায়ের দিকে
আসেপাশের চুড়িপট্টির ছেলেদের বা মাছবাজারের পসারিদের নাদানকির তাকানি দেখি নাই।বাুবুর
মায়ের চর নির্মলেন্দু গুনের ছাদ থেকে দেখা রোমান্টিক কামরাঙ্গির চর নয়।
কাব্যপ্রতিমা জুলেখাকে কাজের বুয়া বলাতে আমার আপত্তি নাই।ইনবক্সে যারা বলছে তারা যদি
সিন্ডারেলার কাহিনিটার সারমর্ম বুঝতো, তারা বুঝতো রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে 'সামান্য ক্ষতি'
লিখেছিল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার পুরোটা সময় আমার প্রেমিকা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির
এক্টিভিস্ট, পরে পার্টি নেতাদের ঘটকালিতে এক ব্যাঙ্কারের দিকে চলে যায়।সেই প্রেমিকা, ঐ
ব্যাঙ্কারের ছেলেমেয়েদের সাথে নিজের ছেলেমেয়েদের ছায়ানটে, সঙ্গিত ভবনে পাঠানোতে রুচিগত
বিরোধও বাংলাদেশ ছাড়বার এবং বাঙালি ডায়াস্পোরা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখবার একটা কারন।
বাবুর মাকে পরনের শাড়িতে গোসল করে পরনে শুকাতে হয়, প্রেমিকাকে ব্যাঙ্কারের কাছে চলে
যেতে হয়।লোলুপ না হয়ে, ঐ ভেজা শাড়ি ভেদ করে রক্তমাংসঅস্থিমজ্জার যে বাবুর মা এবং সেই
বাবুর মায়ের ভেতর সন্তান বাবুকে ঘিরে যে সাইকাডেলিক-স্বপ্নভ্রুন, তাই বিকশিত জুলেখাতে;
ব্যাঙ্কিংয়ের জাবেদা, খতিয়ান পার হয়ে আমার ঢাবি প্রেমিকার যে স্বপ্ন ছিলো বৈশম্যের বিরদ্ধে, তারই
নান্দনিক স্মারক জুলেখা!জয় হোক জুলেখার।
চয়ন খায়রুল হাবিব
৩০/০৯/১৫
ব্রিটানি