Thursday 2 August 2012

১৫ই অগাস্ট এবং যদ্যপি কুঠিয়াল সেনাবাহিনি

''বর্ষবরণের খোপায় ঘুরে বেলি হেসেছে
টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে
গোলাপেরা অভিমানের আতরজলে গাঢ়''

২০০৭এর অক্টোবারে আর্টস.বিডিনিউজের' প্রথম সংস্করনে অংশগ্রহনের নিমন্ত্রন আসবার কিছুদিন আগে থেকেই 'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ' পান্ডুলিপি তৈরি করছিলাম।বর্মাতে সামরিক জান্তার হাতে বৌধ্ব ভিক্ষুদের দানবিয় হত্যাযজ্ঞকে স্বকৃত সনেটের নান্দনিক মাপে নিয়ে আসবার সময় উপমহাদেশে সামরিক নিপিড়ন এবং তার বিরুধ্বে আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের সংহত প্রতিক হিসাবেই উপরের লাইনগুলা তার সমস্ত ব্যাঞ্জনা, উতপ্রেক্ষা, ইতিহাস নিয়ে পরবর্তি ৩ মাস একের পর এক সনেটের চিত্রকল্প তৈরি করে।শোক হয়ে ওঠে উদ্বোধনঃ ক্ষনার প্রবচনের পাশে  ৭ই মার্চ রুপ নেয় সহোদর-সনেটে। 
একের পর এক পালটা অভ্যুথ্যানে কর্নেল, জেনারেলদের  মারনযজ্ঞ্বে স্পস্ট হয়ে গেছিল যে ১৯৭২এর সংবিধানের সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বুনিয়াদ ধ্বংশ করে, ১৯৭১এ অর্জিত প্রবর্তনাগত শেকড়গুলা উপড়ে ফেলাই ছিল ১৫ই অগাস্ট হত্যাকান্ডের নিহিত লক্ষ্য।এর পর একের পর এক প্রজন্মকে কারিকুলাম বদলে দিয়ে এমন একটা আভিধানিক, সাংস্কৃতিক, সাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যেখানে হত্যাকারিদের বলতে হচ্ছে, ''সেনাবাহিনির কতিপয় বিপথগামি অফিসার'' আর সেনাবাহিনি শব্দটা বলতে হলে প্রায় বাধ্যতামুলকভাবেই যোগ করতে হচ্ছে, ''দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনি''!আমরা কি বলি, ''দেশপ্রেমিক ডাকবিভাগ'' বা ''দেশপ্রেমিক বস্ত্রশিল্প'' বা ''দেশপ্রেমিক বিশ্ববিদ্যালয়''?

তোপের মুখে পুরা একটা জাতিকে জিম্মি রেখে দেশপ্রেমের নামে যে যুগব্যাপি সামরিকায়ন, তার মাশুল বাংলাদেশ কিভাবে পরিশোধ করছে তা খতিয়ে দেখা যাক।বাংলাদেশের আশি ভাগ বাজেট তৈরি হয় বস্ত্রশিল্পে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে, যার পরিমান বছরে প্রায় ১৮বিলিয়ন ডলার।বাংলাদেশের বাজেটের বাকি ১০ভাগ আসে প্রবাসে শ্রমবাজারে নিয়োজিত ৬ মিলিয়ন শ্রমিকের বাতসরিক ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে।বাদবাকি ১০ শতাংশ আসে অন্য সমস্ত খাত থেকে।NGOকে যত ফুলায় ফাপায়ে দেখানো হয়, তার একটা ভুমিকা থাকলেও বস্ত্রশিল্পের এবং বিদেশে নিয়োজিত শ্রমিকদের তুলনায় তা নগন্য।বিদেশে নিয়োজিত শ্রমিকদের একটা অংশ পুলিশ, সিপাহিরা হলেও, সেনাবাহিনির তুলনাতে অন্যন্য দেশরক্ষা বিভাগগুলার যে তাতে অংশগ্রহন প্রায় শুন্য সে-অসন্তোশের জের ধরেই বি, ডি,আর বিদ্রোহে।স্মর্তব্য যে বি,ডি,আর বিদ্রোহের পর তদন্ত কমিটি সেনাবাহিনির বিবিধ ব্যবসায়িক কর্মকান্ডকেও একটা প্রধান কারন হিসাবে চিনহিত করে, তা বন্ধ করার সুপারিশ করলেও, তা কার্জকর করা হয় নাই।

বাজেটের বিভিন্ন খাতের ব্যায় কমায়ে সেনাবাহিনি খাতে ব্যায় বাড়ানোতো হচ্ছেই দফায়, দফায়; এখন সারাদেশের মানুষের পাসপোর্ট ইস্যু
বাবদ যে ফি তার একচেটিয়া সংগ্রাহক সেনাবাহিনি প্রতিষ্ঠিত 'ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক''।বিমানবাহিনির হাতে বেসামরিক বিমান চলচল ব্যাবস্থাপনা।সাংবিধানিক অধ্যাদেশ করে সেনাবাহিনিকে ব্যাঙ্কিংএর পাশাপাশি হোটেল ব্যবসাতেও আসতে দেয়া হয়েছে।জেনারেলরা র‍্যাডিসন হোটেলের মালিকানা ছাড়াও 'সেনাকল্যান সংস্থার' মাধ্যমে আইসস্ক্রিমসহ, বিবিধ ভোগ্যপন্য ব্যবসাতেও জড়িত; সেনা সদ্যস্যদের আবাসনের নামে নামুমাত্র মুল্যে জমি দখল করে তা দিয়ে হাজার কোটি টাকার আবাসন ব্যাবসা।জমিদখলে আপত্তি ওঠালেই মামলার পর মামলার হয়রানিতে ফেলে, গ্রামের পর গ্রামবাসিকে ভিটাছাড়া করা।মিডিয়া মালিক, সাংসদেরা এতরকম স্বার্থে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বাধা যে ক্ষমতায়নের পুরা কাঠামোটাই একটা ব্ল্যাকমেল পর্জায়ে চলে গেছে।

সামরিক বাহিনিগুলার কর্মকর্তাদের আচরন উপনিবেশিক কুঠিয়ালদের মতই।যারা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে অর্থনিতিতে, সেই বস্ত্রশিল্প-শ্রমিকদের ন্যুনতমো, ন্যাজ্য আন্দোলনে যখন বিদেশি বিনিয়োগকারিরা কিছু মনে করছে না এবং দাবি মেনে নিতে চাইছে, তখন এসব আন্দোলনগুলাকে দমন, পিড়নে ব্যবহার হচ্ছে যে সামন্তবাদি RAB তার পেছনেও সেনাবাহিনি।২০/২২ বছরের সেনা অফিসারেরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কাকে মারা হবে, কাকে ছাড়া হবে।নির্মমতমো অত্যাচারের স্মারকচিন্ন রেখে লোকজনকে গুম করা হচ্ছে।ঠিক যেভাবে বংগবন্ধুকে হত্যার পর গুম করা হয়েছিলো।যেভাবে ইন্ডেমনিটি বিল করে বংগবন্ধু হত্যাকারিদের আইনের উর্ধে নেবার চেষ্টা করা হয়েছিল; একইভাবে বিভিন্ন সাংবিধানিক, আমলাতান্ত্রিক ইম্পিউনিটি তৈরি করে RABএ ডেপুটেশানে আসা সেনা-সদস্যদের আইনের উর্ধে নেয়া হয়েছে।

উর্দিধারিদের মানুষ হত্যার লাইসেন্স দিয়ে এবং তাদের আইনের উর্ধে রেখে কিভাবে আইনের শাষন কায়েম হবে তা বোঝা দুস্কর।তা যে চাওয়াও হচ্ছে না তাই বরং স্পষ্ট।বেসামরিক আইনরক্ষাকারিদের প্রতি আস্থা সম্পুর্ন নস্ট করে দিতে পারলে, বস্ত্রশিল্পসহ সারাদেশকে কথিত নিরাপত্তা ও স্থিতি দেবার নাম করে জায়গায়, জায়গায় 'ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক' বসায়ে দেশের ৮০%শতাংশ আয়ই আত্মসাত করা যাবে।শিল্পপতিরা যেরকম আলাদিনের চেরাগমার্কা চুড়ান্ত বিলাসি বৈশম্যে ক্লাবক্লাসগুলাতে হাওয়াই জিবন যাপন করছে, তাতে বোঝা যায় যে গনতন্ত্র রক্ষার চেয়েও জার্মান, ইটালিয়ান ফ্যাসিস্ট কায়দায় সেনাবাহিনিকে ভাগ দিয়ে মুনাফা লুন্ঠনেই তারা বেশি আগ্রহি।লুন্ঠনের পর বাদবাকি যা থাকবে তা দিয়ে সামগ্রিক পুস্টিবিধান এতটাই অসম্ভব হবে যে আন্দোলন কেন, কোনরকম বিরোধিতাই সম্ভব হবে না।বর্মাতে এভাবেই দির্ঘমেয়াদে শ্রম দাসত্ব আরোপ করে সামন্তবাদি সামরিক শাষন কায়েম করা হয়েছে।গনতান্ত্রিক সরকার সামরিক বাহিনিকে ব্যাঙ্কিং-এ আসতে দিচ্ছে তার নজির কেবল পাকিস্তানেই আছে।আর সেখানে যে সামন্ত-সেনাবিহিনি ভয় দেখিয়েই এসব করছে তা জানতেতো আর আমাদের বাকি নাই।আবার সমাজের সামরিক-ক্ষমতায়নে পাকিস্তানের মতই যে বাংলাদেশেও উপনিবেশিক এলিটিজম প্রসুত ক্যাডেট কলেজ এসোসিয়েশানগুলাও যে সম্পুরক ভুমিকা রাখছে তাও দ্রস্টব্য।

ইতিহাসের নিশানাচিন্ন উদ্ধার ছাড়াও বাংগালির চিরায়ত মিথ হিশাবেও বংগবন্ধু  অবিসংবাদিত মর্জাদায় প্রতিষ্ঠিত।দেশের বস্ত্রশিল্প-শ্রমিক এবং বিদেশে শ্রম বাজারে নিয়োজিত শ্রমিকেরও যথাযোগ্য মানবিক মর্জাদা প্রাপ্য।শ্রমিকের বিরুধ্বে বার বার সৈনিকদের সামন্তবাদি উপায়ে ব্যবহার করা হলে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে তার পায়ের নিচে মাটি হারাবে।পরিবেশ দুষনে তা আক্ষরিকভাবেই ঘটছে।৩০ বছর পর যখন বাংলাদেশের ভুমি আরো কমে যাবে, তখন এই শ্রমিক শক্তিই বাংলাদেশকে উদ্ধার করবার কথা।কিন্তু তাকে পিষতে, পিষতে আরো নিচে নেয়া হলে অশনিসঙ্কেত কোন বন্দুকের নল দিয়েই রোখা যাবে না।

চয়ন খায়রুল হাবিব
২/০৮/১২
ব্রিটানি-ফ্রান্স


বাংলাদেশ সেনাবাহিনির ব্যবসায়িক ততপরতা নিয়ে বিবিসি'র প্রতিবেদনঃ
http://www.bbc.co.uk/news/world-south-asia-10801268