Sunday 10 June 2012

''দেয়াল''এর দোলাচলে



সেনাবাহিনির অফিসারদের হাতে স্বপরিবারে বংগবন্ধু হত্যাসহ ১৯৭৫এর ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে, করাল ক্যান্সারে আক্রান্ত উপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ চিকিতসা চলাকালিন সময়েই লিখেছেন ''দেয়াল''।প্রথম দুই কিস্তি বের হয়েছে 'প্রথম আলোতে'।প্রকাশিত অংশের কিছু 'তথ্য প্রমাদ' বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল আদালতের নজরে আনলে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরি এবং জাহাঙ্গির হোসেনের বেঞ্চ শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের নথিপত্র এবং সাক্ষ্য প্রমান  যাতে লেখকের হাতে তুলে দেয়া হয়, সে-ব্যপারে ১২ দিনের ভিতর সাড়া দিতে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছে।আদালতের হস্তক্ষেপের আগে এবং পরে 'প্রথম আলো' যে-পরস্পরবিরোধি তথ্য দিয়েছে তা পত্রিকাটার উদ্যেস্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ্ব করে!

''প্রথমেই মেনে নেওয়া ভালো, হুমায়ূন আহমেদের লেখায় অনেক তথ্যের ভুল আছে। তবে ব্যাপারটি কেবল তথ্যেরই নয়। উপন্যাসের প্রকাশিত অংশটুকুতে হুমায়ূন অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের লিগেসি অব ব্লাড-এর ওপর একটু বেশি মাত্রায় নির্ভর করেছেন।বইটি বিতর্কিত ও গোলমেলে। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে বইটি বেরোয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহননের একটি সূক্ষ্ম প্রকল্প বইটির মধ্যে অনেকে লক্ষ করেছিলেন। এমন একটি জল্পনা চালু ছিল যে, এ বইয়ের প্রকাশ এরশাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ। এসব অভিযোগ ও বিতর্কের মুখোমুখি না হয়ে হুমায়ূন আহমেদের উপায় নেই।'' সাজ্জাদ শরিফ/প্রথম আলো/সাহিত্যের সিমানা ও আদালতের দায়...০৯/০৬/১২

উপরের অভিযোগটা সত্য হলে এবং প্রথম আলোর কর্মকর্তা সা।শরিফের  তা জানা থকলে  ''অনেক তথ্যের ভুল'' এ ভরা উপন্যাসটার শুরুর কিস্তিগুলা প্রকাশ করা ঠিক হয় নাই।কথিত ভুলে ভরা লেখা প্রকাশই বা কেন?মাসকারেনাহাসকে টেনে আনা কি সেনা সমর্থিত শেষ কেয়ার টেকার সরকারের মাইনাস টু' নিতির পক্ষে 'প্রথম আলো' যে ভুমিকা রেখেছিল, তা আড়াল করবার প্রয়াস?

''দেয়াল'' উপন্যাসটার প্রাক-প্রকাশনা পুর্নাংগ পাঠকদের একজন অধ্যাপক সৈয়দ মনঞ্জুরুল ইসলাম।প্রথম আলোতে প্রকাশিত সৈয়দ মঞ্জুরের পুর্নাংগ পাঠ নির্ভর রিভিউতে আস্থাবান হলেও সাজ্জাদ শরিফের অভিযোগ অসার হয়ে পড়েঃ
''আমাদের জীবনকালের যে ইতিহাসে আমরা ছিলাম, তা নিয়ে যখন বিতর্ক সৃষ্টি হয়, নানা বিকৃতির রং তার ওপর চাপানো হয়, তখন একজন ইতিহাসবিদের ভূমিকা নিশ্চয় হওয়া উচিত সত্যসন্ধানীর। যখন সে রকম উদ্যোগ চোখে পড়ে না, অথচ ইতিহাসের সত্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তখন একজন লেখক নামতে পারেন সেই সত্যসন্ধানীর ভূমিকায়। দেয়াল উপন্যাসে সেই কাজটি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ...। এই উপন্যাসে তিনি কোনো ইতিহাসবিদের জায়গা নেননি, যদিও একজন ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্যনির্ভরতা তিনি বজায় রেখেছেন।'' সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম/প্রথম আলো/ইতিহাসের দায়মুক্তি/১১-০৫-১২

সৈয়দ মঞ্জুরের নিচের অংশটুকু পড়লেও বোঝা যাবে যে হূমায়ুন আহমেদ মাসকারেনাহাসের উপর ''একটু বেশি মাত্রায়'' কি কোন মাত্রাতেই 'নির্ভর' করে নাইঃ
''আমরা বুঝি বঙ্গবন্ধু মানুষ চিনতে কখনো কখনো ভয়ানক ভুল করেছেন, ট্র্যাজিক নায়কদের মতো, যেমন খন্দকার মোশতাক আহমদকে, খালেদ মোশাররফকে; হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন; কর্নেল তাহেরকে পুনরধিষ্ঠিত করেছেন তাঁর বীরের আসনটিতে। এ দুই চরিত্রের এক আশ্চর্য নিরাবেগ চিত্রায়ণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসের দায় থেকেই।এ উপন্যাসে জিয়াউর রহমানও আছেন এবং আছেন তাঁর ভূমিকাতেই। জিয়ার প্রাণ রক্ষাকারী বন্ধু কর্নেল তাহেরকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, দেখা গেল কর্নেল তাহেরের কোনো অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে, শুধু অসম্ভব এক স্থিরচিত্ততার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বীরত্ব এবং দেশপ্রেম কাকে বলে তার এক অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন।'' সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম/প্রথম আলো/ইতিহাসের দায়মুক্তি/১১-০৫-১২

প্রথম আলো কি নিকট অতিতের কির্তি ধামাচাপা দিতে হুমায়ুন আহমেদকে পাটকেল বানায়ে বেশ কিছু পাখি শিকারে নেমেছে? একজন লেখককে মাঠে নামায়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাতে পত্রিকাটার প্রনোদনার জায়গাটাও পাঠককে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়!

সাহিত্যিক তথ্যগত উপাত্ত নির্ভর হয়েও তথ্যের যে-ক্ষ্মতায়ন, তার বাইরে প্রতিকি ব্যঞ্জনা তৈরি করে!পাঠকের মনে এমনসব প্রশ্নের পার্স্পেক্টিভ সাহিত্য তৈরি করতে পারে, ঐতিহাসিক বা আদালতের কেস হিস্ট্রি দিয়ে তা সম্ভব না।সেরকম হলে ভাওয়াল সন্যাসি মামলা বা অন্যন্য বিখ্যাত রায়ের বিবরনি লোকে সাহিত্য হিসাবে পড়তো, সাহিত্যিকদের আর আলাদা করে লিখতে হ'তোনা।শিরাজোদৌলা, নেপোলিয়ান, গান্ধি, আলেন্দে নিয়েও লেখা আসতো কেবল আদালতের পেষকার এবং বিজয়ির নিযুক্ত ইতিহাসবিদের কাছ থেকে!কারবালার ইতিহাসে যে নৃশংস-নিরাবেগ- নৈর্ব্যাক্তিকতা, ''বিষাদ সিন্দু'' কি তাতে ব্যাক্তিক নন্দনের দোলাচল যোগ করে না?

অবস্য এটাও দ্রস্টব্য যে বর্তমান সরকার  ১৯৭৫ সংশ্লিষ্ট অপর হত্যা মামলাগুলার-বিষয়ে আদালতের  দৃষ্টি আকর্ষন করেছে এবং কিছুক্ষেত্রে আদালতের রায় আদায় করতে পেরেছে।এরপরও তুলনামুলক সাহিত্যের দায়ভার পাঠকের হাতে থাকাটাই কি ইতিহাসের রক্ষাকবচ নয়?

সাধারন মানুষের সাধারন জ্ঞ্বানের সিমানার ভিতরেই একটা অভিপ্সা হচ্ছে তথ্যকে ক্ষ্মতায়ন, মতবাদের জোতদারি এবং একাডেমির রেফারেন্স সুত্রের বাইরে এসে দেখার চেষ্টা!ব্রামন্যবাদের দৌরাত্মে ''প্রাদোষে প্রাকৃতজন'' এ আমরা একটা বৌধ্বিক-কৌমকে পাই, কিন্তু সে-কৌমের কোন ব্যাক্তির নাম জানতে পারিনা।সমকালিন ইতিহাস নাম নিশানাহিন হোক তা য্যামন চাইনা, সেইরকম রুল নিশি জারি করা আরোপিত সাহিত্যও আমরা চাইতে পারি না।

আমরা যেমন চাইবো না যে আদালতে সাহিত্যের সিমা সরহদ্দ নিরুপিত হোক; সেরকম ভাবেই চাইবো না কোন পত্রিকার বোর্ড সাহিত্যকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাক কিম্বা বলে দিক এভাবে, ওভাবে সাহিত্য রচিত হোক।এতে আদালত এবং গনমাধ্যম দুটাই অপশক্তিতে পরিনত হয়।

চয়ন খায়রুল হাবিব
১০/০৬/১২
ব্রিটানি