Monday 21 February 2011

যে দ্রোহ প্রতিকে খলশায়ঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১১

অক্টোবার থেকে ফেব্রুয়ারি ৫ মাস বাংলাদেশে দাপাদাপি করলাম।২০ বছরে এই প্রথম একনাগাড়ে এতদিন থাকলাম!এর ভেতর ২০০০ সালে এসেছিলাম কয়েক
সপ্তাহের জন্য; সেটা ছিল ভারতে ঘোরাঘোরির অবকাশে স্ত্রি প্যাট্রিসিয়ার সাথে মা, বাবা'র দেখা করায়ে দিতে!সেবার ছিলাম আমার  আশৈষব বেড়ে ওঠা আজিম্পুরের
বাসাতে!ইউরোপ ফিরে যাবার ৬ মাসের ভিতর বাবা হাবিবুল মারা গেলে মা'কে সংগ দিতে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছিলাম আবার কয়েক সপ্তাহের জন্য!তারপর
মা জ্যোতির ক্যানসারের সংবাদে ঢাকাতে এসেছিলাম ২০০৩ এ!সে-বছর আমার ছেলে মাতিস-জ়্যোতি'র জন্ম হয় ফ্রান্সের ভ্যান শহরে!তারপর আবার ২০০৭এ,
মাত্র এক মাসের ছুটিতে!২০১০এর অক্টোবারে শুনালাম  মা-জ্যোতির চোয়ালের ক্যান্সার জটিলতায় গড়ায়েছে; থেরাপিতে আর কাজ হবেনা।এর ভিতর আমি
লন্ডনের কাজ, বসত গুটায়ে প্যাটি, মাতিসের কাছে ভ্যান শহরে চলে এসেছি!কাজ বলতে ফরাসি শেখা, ৪/৫ ঘন্টা অভ্র ফন্টে বাংলা গদ্য-পদ্য টাইপ করা এবং
ঘরকন্যা!দাদু-জ্যোতির সাথে এর ভেতর ফরাসি নাতি মাতিস-জ্যোতির কয়েকবার ফোনে আলাপ হয়েছে!দাদুর চোয়ালে ক্যানসারের কারনে কথা বেশিদুর এগোয়না!
মাতিসের প্রায়ই দাদুর জন্য মন খারাপ থাকে!ঠিক করলাম শেষ সম্বল কাচায়-কুচায়ে ৭ বছুরে মাতিস'কে সেই মাহিলাটাকে দেখায় আনি, যার পাশে শুয়ে শুয়ে
রবিন্দ্রনাথ, নজরুল, জসিমুদ্দিন শুনতে শুনতে আমার হৃতস্পন্দনে কবিতার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল; আর জমজ বোন কঙ্কনের হাতে জেগে উঠেছিল এক অমোঘ শিল্পির
তুলি!


এর ভেতর আম্মা আজিম্পুরের বাসা ছেড়ে কঙ্কনসহ  উঠে এসেছে বড় বোনের ঢাকা ক্যান্টের ভাড়া বাড়িতে!কেন বড় বোন এত জায়গা থাকতে ক্যান্টনমেন্টে বাড়ি
ভাড়া নিল সে আরেক জটিল বয়ান!এই পোস্টের বয়ান সিমিত রাখি আমার ৫ মাস ব্যাপি বাংলাদেশ অবস্থানের উপর!অক্টোবারে আসবার পর আম্মার পাশে বসে
বসে মাতিস ফরাসিতে, ইংরেজিতে পিটপিটায়; আম্মা নাতির মাথাতে হাত বুলাতে, বুলাতে বাংলাতে বাতচিত চালায়!আমি আর প্যাটি হাসি; আমাদের মন ভরে যায়!
ক্যানসার'ত আর সারবে না; এক হোমিওপ্যাথ বেশ সার্থকভাবেই কিছু পার্শ-প্রতিক্রিয়া কমাতে সহায়তা করলো প্রচুর অর্থের বিনিময়ে!তবে মাতিসের পিটপিটানিও
বোধ করি আম্মার ভয়াল যাতনায় সহায় হ'লো!সকালে উঠেই মাতিস আম্মার ঘরে গিয়ে বলতোঃ 'দাদু, আমি তোমাকে ভালোবাসি'!এর চেয়ে মহৌশধি প্রতিক আর কি হতে
পারে !

ঐ অক্টোবারেই প্যাটি, মাতিস'কে নিয়ে চলে গেলাম গড়াই নদির তিরে কুস্টিয়াতে লালনের মেলাতে!মেলার আগের কয়েক দিন ঘুরে বেড়ালাম লালনের মাজারের আশেপাশের
গ্রামগুলাতে, শুনলাম সাধুদের গান; গড়াই পার হয়ে ঘুরে বেড়ালাম শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে!সাধুদের আর ক্ষেপিদের গিয়ার-আপ দেখতে, দেখতেই বুঝতে পারছিলাম
সিন্থেটিক আর অর্গানিকের পার্থক্যঃ

সব সাধুর হাতেই মোবাইল ফোন; সিন্থেটিক-সাধুরা খুব জানে কে ব্যারিস্টারের ছেলে, মেয়ে...কে মন্ত্রির ছেলে, মেয়ে...কে এসেছে কোথা থেকে তা বুঝে সাধুরা কাউকে সাধে আপেল, কাউকে শুধুই মঞ্জরি-সঞ্জাত-শুকনা-হাসি!এর মধ্যে ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের এক রকমের মোজেজা শোনা যায়; ঐ
মোজেজার জোড়্গুলাতে স্বামি স্থপতি হলে, স্ত্রি হিসাবরক্ষক কিম্বা স্বামি সফটওয়ারের চালিয়াত হলে স্ত্রি টি, আই, বির কন্সাল্ট্যান্ট!এরকম এক সন্দেহপ্রবন স্ত্রি মেলাতে এসেছে
স্বামি কি করে তা দেখতে; হোটেলে আমাকে পাকড়াও করে জানালো যে সে ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে আমার সাথে বানিজ্যা বিভাগে একই ব্যাচের ছিল, তখন কথা হয় নাই
অথচ এখন কত কথা হচ্ছে!আমি তাকে নির্মমভাবে জানায়ে দেই যে, এখনো আসলে কোনোই কথা হচ্ছে না!২৭ নম্বর তথা ধানমন্ডির ভুমিদস্যুরা দেখি একজন আরেক্কজনে'কে
কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞ্বানি, অধ্যাত্মবাদি ইত্যকার সম্বোধনে আহ্লাদে নয়খানাঃ আহা, আহা ভগ্ন থেকে পুর্ন সাধুসঙ্গের ইন্তেজারি NGO!প্রতিকের
এরকম চালিয়াতি বলাতকার জনম, জনম সাধনায়ও মেলেনা!মহানগর থেকে আসা গ্রাম্যদের বন্ধগুলা কাটায়ে মাতিস, প্যাটিকে নিয়ে আলপথ ধরে খোলা প্রান্তরে চলে যাই!
দেখা হয়ে যায় ঠিক, ঠিক মির মোশাররফ হোসেন আর কাঙ্গাল হরিনাথের সাথে!টকটকে লাল হয়ে ওঠা প্যাট্রিসিয়ার ঠোটে চুমু দিয়ে বলিঃ লালন ক্ষেপিসে!

আঞ্চলিক ভাষা আসলে কি? একজন যদি উচ্চারনে, লেখনে কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, বগুড়ার ঝোক বজায় রেখে দাবি করে যে এটা ঢাকাইয়া; সেই উপস্থাপনাকে আঞ্চলিক
না বলে বিটকেলে ভাষা বা প্রতিকের গোলমালই বলা উচিত!লালন উচ্চারনে আঞ্চলিক থেকেও বিস্বাসে বিশ্বায়িত যা পরে বিস্তৃত হয়েছে রবিন্দ্রনাথে, নজরুলে!এই একই জায়গা থেকে জিবনানন্দ বরিশালের ভাষাতে লেখেন না, মুজতবা আলি সিলেটের ভাষাতে লেখেন না!

মাতিস, প্যাটি নভেম্বারে ফ্রান্সে ফেরত চলে গেলে আমি আম্মার কাছে আরো কয়েক মাস থেকে যাবার সিন্ধান্ত নেই!একটা উসিলা আর কি!কবিতা পড়তে চলে গেলাম
চিটাগাং; সেখান থেকে রাঙ্গামাটি পারায়ে তবলছড়িতে মোনঘর বুধ্যিস্ট আশ্রমে; একেবারে নেংটা হয়ে ঘুরলাম ছড়া থেকে ছড়ায়; দেখলাম 'মানুষের জন্য' জ়াতিয়
NGO সাইনবোর্ড গ্রাস করে ফেলেছে পাহাড়ের পর পাহাড়!শুনলাম চাকমাদের অভিযোগঃ ফরাসি সরকার তাদের অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে!বলতে ইচ্ছা করলো যে
ফরাসি অনুদান তৈরি হয় জনগনের কর থেকে; আর সে-অনুদানের লক্ষ্য থাকে অনুদান-গ্রহিতার স্বনির্ভরতার দিকে; কিন্তু চারদিকে তাকায়ে NGO সাইনবোর্ড ছাড়া
আত্মনির্ভরতার কোন আয়োজন চোখে পড়লো না!বলতে ইচ্ছা করলো যে আমার স্ত্রির পরিবারের মত অনেক সমাজতন্ত্রি আছে যারা চায় না সরকারি অনুদানের টাকা
NGO দের হাতে গিয়ে পড়ুক!আবার যেখানে আমার স্ত্রি, সন্তানের জন্ম, ফ্রান্সের সেই ব্রিটানি প্রদেশেই এ-যাবত সবচেয়ে বেশি চাকমা অনাথদের দত্তক নেয়া হয়েছে!ব্রিটিশ এক দুদে NGO কর্মি দোচুয়ানি পার্টিতে যাবার আগে আমাকে শোনালো কম্বোডিয়া থেকে রাঙ্গামাটি অব্দি তার ম্যাপিংযের খুটিনাটি!আশ্রমের বাচ্চাদের সাথে তাতক্ষনিক এক ওয়ার্কশপে বাংলা ও চাকমা দন্ত স'য়ের উচ্চারনগত পার্থক্য জ়েনে নিলাম!জানলাম স্থানিয় প্রশাষন চাপ দিচ্ছে আশ্রমে বুধ্যিস্ট বাচ্চাদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের অনুসারিদেরও ভর্তি করতে!বুঝলাম না স্থানিয় প্রশাষন বাংলা ভাষার শহিদ মিনারের সাথে কিভাবে চাকমা ভাষার শহিদ মিনারের ভাস্কর্য-ভারসাম্য নির্ধারন করবে?
শহিদ মিনারও তাহলে কি জোর যার মুল্লুক তার-এর প্রতিক?বাঙালি প্রশাষনের কাছে যেমনি চাকমা'রা; তেমনি কি চাকমা NGOকর্মিদের সামনে ম্রো'রাও
ব্রিড়াবনত হয়ে যায়?এসব ভাবতে ভাবতে পাহাড় থেকে নেমে আসি!

ঢাকাতে আমার এক বাল্য বন্ধুর  বাসাতে দেখা হয় বন্ধুর পঙ্গু মায়ের সেবারত এক সুঠাম গারো যুবতির সাথে!জানালাম যে চলেশ রিচিল'কে নিয়ে আমি বিরগাথা
রচনা করেছি এবং গানে বেধে তা লন্ডনে শুনানো হয়েছে!গারো সেবিকা আমাকে জানালোঃ 'ঢাকাতে আমরা রাজনিতির আলাপ করি না!'তবে ও আমাকে মনিপুরি
পাড়াতে গারোদের লোকমান্দি অর্থাৎ খ্রিস্টান  উপাসনালয়ের কথা জানালো!

ডিসেম্বারে এসে শেষ করলাম  আমার প্রথম কাব্যনাটক জুজুঃ জুলেখার জুয়াচাক্কি!পালাকার নাট্যদলের হাতে নাটক'টা মঞ্চস্থ করবার ভার দিয়ে প্রস্তুতি নিলাম 'কুমিল্লা
উতসবের"!ধর্মসাগর দিঘির পারে রানির কুটিরে সে আরেক কাহিনির ভিতর কাহিনি!ঢাকার কাছাকাছি কুমিল্লাতে কিশোর, কিশোরিদের সাথে মুক্তিযুধ্ব ভিত্তিক
নাটকের ওয়ার্কশপ করবার সময় আবার মুখোমুখি হলাম আঞ্চলিক আর প্রমিত উচ্চারনের সিমাসরহদ্দ নিয়ে!অংশগ্রহনকারিদের যখন অনুরোধ করলাম কুমিল্লার ভাষাতে
নিজেদের মত করে সংলাপ বানায়ে নিতে তখন ওরা তা না করে প্রমিত উচ্চারনেই সংলাপ বানাবার সিধ্বান্ত নিল!কিন্তু সেই প্রমিত উচ্চারনে কুমিল্লার ঝোকটা
আমার বেশ আরামদায়ক মনে হ'লো!ঝোক বা accent আসলে এই আরামেরই বাচনিক আয়োজন!এই আয়োজনে অন্যের মাথা কাটবার বা স্বরভংগের অনুশিলন
যোগ না হলেই ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রতিকি ব্যাঞ্জনা সার্থক হবে!

আমার বাংলদেশ অবস্থানের শেষ সপ্তাহ!বেড়িবাধের কাছে সারি, সারি ইটভাটা আমার বুকের বেড়ির ওজন বাড়ায়ঃ পিলখানার সামনে এখনো প্রতিনিধিত্বহিন বিদ্রোহি সিপাহির স্ত্রি সন্তান কোলে এক বোবা শহরের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করছে!না শোনা ঐ প্রার্থনাই প্রতিবাদের প্রতিক হয়ে উঠবে কি?

চখাহা
২১শে  ফেব্রুয়ারি
ঢাকা

















ঢা

















বো
ক্যা