কবিদের নাম ছাড়া অন্যত্র লম্বা ঈকার, ঊকার ব্যাবহার করা হয় নাই।চখাহা।
পর্দার আড়ালেঃ
দ্রস্টব্য যে ২০১০এর মে'তে 'বইয়ের জগত'এর তৃতিয় সংকলনে শহীদ কাদরীর শেষ প্রকাশনা 'আমার চুম্বনগুলা পৌছে দাও' রিভিউতে আব্দুল মান্নান সৈয়দ যে 'পত্রসাহিত্যে'র অবতারনা করেন, তাতে ১৯৭১ পরবর্তি সাহিত্য ইতিহাসের নামে কোন সেমিনারে, কোন টি, ভি অনুষ্ঠানে মান্নান কি বলেছেন সেসবের ফিরিস্তি থাকলেও; সামরিক সরকারের তত্ত্বাবধানে গঠিত 'কবিতাকেন্দ্রের' সংগঠনে নিজের ভুমিকা একেবারেই এড়িয়ে গেছেন!
ঘটনাক্রম মিলালে এ-সময়ের পরিসর হচ্ছে 'কবিতাকেন্দ্র' গঠনের পরে এবং এরশাদের পতনের পর!মান্নান বিভিন্ন রিভিউ এমনকি তার আত্মজিবনিতেও শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী সম্পর্কে এমনসব প্রসংগের অবতারনা করেছেন যেগুলার ক্রস রেফারেন্স করা প্রায় অসম্ভব!মান্নান এসব প্রসঙ্গে প্রবাসি কাদরীর সাথে তার বিভিন্ন ফোন আলাপ'কে রেফারেন্স হিশাবে দাড় করান!এটা সুবিুদিত যে 'কবিতাকেন্দ্র' গঠনের প্রত্যুত্তরে শামসুর রাহমান, কামরুল হাসানেরা যখন জাতিয় কবিতা পরিষদ গড়ে তোলেন তার পর থেকে আল মাহমুদ, মান্নানদের সাথে শামসুরের আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সামাজিক যোগাযোগ ছিলনা!
শহীদ কাদরীর যাপন ও উচ্চারন যত তাকে বাম প্রাগ্রসরতায় ঝোকা ব্যাক্তিক স্বাতন্ত্র বা মুর্ত অস্তিত্ববাদের কাতারে দাড় করিয়ে দেয়, মান্নান তত এটা খুড়ে, ওটা খুড়ে প্রমান করতে বধ্ব পরিকর যে শহীদের মনের টান আসলে কলা কৈবল্যবাদের বিমুর্ততার প্রতি!তার ওপরে সে-একই 'পত্রসাহিত্যে' শামসুরের কবিতাগুলা যে শুধ্বতাবাদের ওজ়োরে যথেস্ট পরিমানে মৌলিক নয় সে-আপত্তি!
''প্রথম বা দ্বিতিয় লাইনটা আসে সচেতনভাবে, তারপর সাব কনশাস(অবচেতন) টেক ওভার করে, আর কোন নিয়ন্ত্রন থাকে না।যেটা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব তা হচ্ছে ক্রাফটম্যানশিপ(শৈলি)।''২০১০
২০১০এ ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক আহসানুল হকের কাছে দেয়া এক সাক্ষাতকারে, 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' কবিতা প্রসঙ্গে কাদরী বলেছিলেনঃ কবিতার মুল প্রবর্তনা কিভাবে রাজনিতির 'উচ্চকিত' প্রচারনা পেরিয়ে অবচেতনের মোচড়ে রুপান্তরিত হয় এবং পরস্পর বিরোধিতাকে ধারন করে!এখন অবচেতন মানে যে ইতিহাসের দায়শুন্য শুধ্বতাবাদ তা কিন্তু কাদরী বলে নাই! কাদরীর শেষ প্রকাশনা, 'আমার চুম্বনগুলো পৌছে দাও' এর রিভিউতে মান্নান যখন বলেন, "সুধীন্দ্রনাথ দত্তের( যার সঙ্গে শহীদ কাদরীর গভীরে কোথাও আশ্চর্য সাধর্ম্য আছে) 'সংবর্তের' পরে এরকম আত্মতাচিহ্নিত কবিতা দেখিনি আর"; তখন কি মনে হতে পারে না যে পঞ্চাশিও কবিতার নিজস্ব 'ভুল পাঠ'কে আবারো পেছনের দরজা দিয়ে সদরে ঢোকানোর ফিকির করছেন মান্নান!
ভুল পাঠ কেন?নিজের দক্ষিনপন্থি নান্দনিক আনুগত্যকে রাজনিতি-বিমুখতার আড়াল দিতে মান্নান বছরের পর বছর ধরে জীবনানন্দকে উদ্যেস্য-নিরপেক্ষ-শুধ্বতাবাদি বলে উপস্থাপন করেছেন!আর আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ, আবু হেনা মুস্তফা কামালদের আনুকুল্যে এই ধারনাই গ্রহনিয় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগগুলাতে!পরাবাস্তব আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রবর্তনাও এড়ায়ে গেছেন মান্নান!কারন সে-রাজনৈতিক প্রবর্তনার পথ ধরে পরবর্তিতে যে-অস্তিত্ববাদ তাতে কিছুতেই মান্নানের ধর্মিও-ভুডু আশ্রয় নিতে পারে না!এজন্যই তাকে বানাতে হয়, 'আত্মিকৃত রাজনিতির' মত শব্দবন্ধনি!
'আত্মচিহ্নিত রাজনৈতিক কবিতার' প্রচুর দৃষ্টান্ত মিলবে শামসুর রাহমানে এবং মৌলবাদি মনান্তর ঘটবার আগের আল মাহমুদে!স্যামসনের, টেলেমাকাসের প্রতিকি পর্ব পার হয়ে 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' এর সেই হোটেল রুমের অভিজ্ঞ্বতা!কাদরীর সতির্থদের ভেতর তুল্যমুল্যে না গিয়ে, সু্ধীন প্রসংগ এনে, 'দেখি নি আর' বলে নিজের পশ্চাদ্মুখিতাই প্রকট করেছেন মান্নান! বাংলাদেশের কবিতার প্রমিত পত্তনি যে স্বাতন্ত্র- সার্বভৌমে দাড়ায়ে আছে, তার আনুষাঙ্গিক প্রাগ্রসর আন্দোলনগুলাতেও নিজের অনুশিলিত-অনুপস্থিতিকে এভাবে আড়াল করবার প্রয়াস পেয়েছেন মান্নান!
শামসুরের কবিতা সম্পর্কে তার মৃত্যুর কিছুদিন পর আল মাহমুদের একটা মন্তব্যকে যথার্থ বলা যেতে পারে; মাহমুদ বলেছিলঃ 'রৌদ্র করোটির' পর রাহমান হেচকা টানে তিরিশিও প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছিলেন!মাহমুদ এও বলেছিলেন যে রাহমান তা করেছিলেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটাকে বাহন করে!শহীদ কাদরী'র বেলায়ও একই মন্তব্য শতাংশে যথার্থ!
বরকন্দাজেরাঃ
প্রয়াত কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন এবং ভ্রান্তিবিলাসি ক্যানভাসার সলিমুল্লাহ খান রাজনিতিকভাবে বিপরিত মেরুর হলেও কবিতা পর্যালোচনার ব্যার্থতাচিহ্নে এদের আচরন একই ধরনের!সলিমুল্লাহ যা না তা মিথ্যাচার ও অতিকস্টকল্পনার ঘোলা জলে শিকার করতে চান শামসুর রাহমান'কে; আর আশরাফের টার্গেট সেই মান্নান সৈয়দি কায়দায় শহীদ কাদরী!
বি, ডি আর্টসের শামসুর নিধনযজ্ঞে সলিমুল্লাহ খান বলছে 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটা শামসুর অনুবাদ করেছে দায় শিকার না করে পল এলুয়ার থেকে!বর্তমান লেখকের স্ত্রি ফরাসিনি হওয়ায় এবং ইংরেজিও ভাল জানায়; তার উপর বর্তমান লেখক চয়নও বাংলা, ইংরেজিতে দ্বিভাষি জিবনজাপনের গুনে একদিন শুভক্ষনে প্রচুর পল এলুয়ার ঘাটাঘাটি করেও সলিমুল্লার অভিযোগের কোন ভিত্তি পায় নাই!শামসুর রাহমানের 'স্যামসন' কবিতার সুত্রে তাকে যেভাবে ইহুদি তোষনকারি ও সাম্রাজ্যবাদের চর আখ্যা দেয়া হয়েছে সে-আলোকে 'জাতীয় কবিতা পরিষদের' সেমিনারে পড়া সলিমুল্লার প্রবন্ধ'টাকে সাম্প্রদায়িকতা অর্থে গ্রাম্য এবং অনৃতভাষন হিশাবেই চিহ্নিত করা শ্রেয়!আর সেখান থেকে পঞ্চাশের অবমুল্যায়নের সুত্রে পরবর্তি্তে আশির কবিতার ভাষা ও শৈলি বদলেরও অবমুল্যায়ন সম্ভব এবং অনেক ক্ষেত্রে তা হয়েছে।
হাজার বছরের টেলেমাকাসঃ
শামসুর রাহমান তার আত্মজিবনিতে বলেছেন যে স্যামসন, টেলেমেকাস জাতিয় আদি পৌরানিক চরিত্রগুলি দিয়ে তিনি বংগবন্ধুকেই বুঝায়েছিলেন!এ- প্রতিকগুলা নিয়ে শামসুরের কোন অবশেশান না থাকলেও শামসুর-বিদ্বেষি আহমদ ছফা এবং তার অনুসারিদের যে অবশেশান আছে তারও আচ পাওয়া যায় সলিমুল্লার প্রবন্ধটাতে!এরা শামসুর-আলোচনায় তার আত্মজিবনিটাকে সচেতনভাবে এড়ায়ে যায়!সলোমন ও দাউদ প্রাচিন ইস্রাইল গোত্রের লোক!সলোমনের গান খ্রিস্টানেরা গাইছে তাদের উপাসনায় নিয়মিত!সে-বাদেও কেউ এখন দাউদ'কে নিয়ে লিখলে ইসরায়েলের এজেন্ট হয়ে যাবে না কি?মহাভারত থেকে নিলে ভারতের চর? তাহলে বাকি থাকে কেবল আরব্য রজনির শেহেরাজাদের কাহিনি!বাহ!
আহমেদ ছফা অনুসারিদের কবিতা বিশ্লেষনের টেকনিক যেমনি অবশেশান আশ্রয়ি একদেশদর্ষিতা; তেমনি এই টেকনিক ব্যার্থ কবির সাথে মহৎ কবির সিমাসরহদ্দ চিহ্নিত করতে অপারগ!মহৎ কবি বহিরঙ্গের ভাষার সাথে অন্তরঙ্গের নিউরোলজিতে প্রতিকের পরম্পরা ধারন করে।অন্তর্গত প্রতিকের পরম্পরা যেমন সজ্ঞার সাথে তার বাস্তবতার সেতুবন্ধন, সেরকম প্রতিকের পরস্পর বিরোধিতার সাথে তাকে নিজের স্ববিরোধেরও একটা ভারসাম্য তৈরি করতে হয়!এখানে একাডেমিকেরা ব্যার্থ হয়ে যায় প্রতিকের পরম্পরা ধরতে না পেরে!বিকল্প লোকনকাচ হিশাবে এরা নেয় দর্শন নির্ভর যুক্তিকে!আর সে-যুক্তির চাপে সত্ত্বার যে সৎ ও সত্যিবোধ তা এদের চোখ এড়ায়ে যায়!যুক্তি-নির্ভর ব্যার্থ কবির একাডেমিক চর্চার সাথে ধর্মান্ধের পার্থক্য নাই বললেই চলে!
শামসুর সংশ্লিষ্ট এই প্রবন্ধটা নিয়ে আমি সম্প্রতি বিস্তারিত কথা তুলি কবিতা পরিষদের বর্তমান সভাপতি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সাথে, যেখানে তিনি পরোক্ষে স্বিকার করে নিয়েছেন যে ২০০৯এ 'জাতীয় কবিতা পরিষদের' মঞ্চ ব্যাবহার করে সাহিত্য সমালোচনার নামে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চালানো হয়েছিল!বটে, যেরকম মঞ্চ, সেরকম তার অবরোহন!
উত্তরাধিকারঃ
শহীদ কাদরী'র প্রথম কবিতা সংগ্রহ 'উত্তরাধিকার' নিয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেন তার 'কবিতার অন্তর্যামী' বইয়ে লিখলেন, "লে ফ্লার দ্যু মাল এর সঙ্গে শহীদ কাদরীর উচ্চারনের মিল এতটা প্রকট যে উত্তরাধিকার এর কবিতাগুলোকে মৌলিক বলতে বাধে!"
এখানে একটা ব্যপার লক্ষনিয়!বাংলা্দেশের কবিতাকে যে দুইজন জীবনানন্দ তথা তিরিশিও প্রভাব ছাড়ায়ে নিজস্ব নাগরিকতার প্রমিত পত্তনিতে দাড় করায়ে দিয়েছে সলিমুল্লাহ, খোন্দকার তাদের দুইজন'কেই তুলনা করেছে ফরাসি কবিতার তস্কর হিশাবে!আবারো ফরাসিনি অর্ধাঙ্গিনি প্যাট্রিসিয়াকে কথাটা জানালাম, বোদলেয়ার নিয়ে দুইজনে বসলাম!প্যাট্রিসিয়া বলে বসলোঃ তোমাদের কবি আমাদের কবি থেকে মেরে দিয়েছে, এরকমটা না বলেত বলা যায়, আমাদের বোদলেয়ার এলেন পো থেকে মেরে দিয়েছে!
খেয়াল করুন যে বোদলেয়ারের বেশির ভাগ সংগ্রহের মুখবন্ধ এলান পোর!এবার বুঝুন বোদলেয়ারের উপর এলানের প্রভাব!তার উপর এও শুনিনি যে এই দুই শিক্ষক ফরাসি ভাষায় লিখতে, পড়তে জানেন!বাংগাল'কে ফরাসি-হাইকোর্ট দেখানো আর কি!আমার দেখাতে একটা গোষ্ঠি বিভিন্ন বিপরিতমুখি স্বার্থ থেকে সচেতনভাবে বাংলাদেশের সাহিত্যের অর্জনগুলাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে!এদের স্পিনিং, ডক্টরিংযের লক্ষ্য প্রথমত বাংলাদেশের কবিতার পরম্পরাটা হয় নস্যাত করা, নয়ত দুর্বল করে দেয়া!এই প্রয়াসের মুল অভিপ্রায় হচ্ছে সাহিত্যের এবং সংস্কৃতিক প্রাগ্রসরতার ভুল পটভুমি তৈরি করা!পরম্পরাগত দুর্বলতা থাকলে এবং ভুল ইতিহাস তৈরি করা গেলে , আশির দশকে যে ভাঙ্গা লিরিক/খোলামিলের বিস্তার ঘটানো হয়েছে তাকেও এড়ায়ে যাওয়া সম্ভব শামসুর, শহীদ'দের অবমুল্যায়ন ঘটায়ে!
শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদকে নিয়ে আরো খোড়াখোড়ি হবে!শেষ কথাগুলার মোড় ঘুরবে বার বার প্রজন্মান্তরের পাঠকের হাতে!কিন্তু গোষ্ঠিস্বার্থ মেশানো ভুল ও বিকৃত পাঠের উতর চাপানগুলার মোকাবেলা হবে পথ চলতে, চলতেই!এটুকু বলা যায় এখনই যে পঞ্চাশের পর বাংলাদেশের কবিতাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই!
চয়ন খায়রুল হাবিব
১৮/০৮/১০
ব্রিটানি
শহীদ কাদরীর প্রয়ানে সামান্য পরিমার্জিত।আগের শিরোনাম ছিলো, 'শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর বিকৃত উপস্থাপনা''।চখাহা।২৯/০৮/১৬।ব্রিটানি।
''যখন দেশ ছেড়েছিলাম...তখন ঠিক করেছিলাম আমি আর লিখবো না। বাংলা সাহিত্যের সাথে, বাংলা ভাষার সাথে আর কোন সংস্রব রাখবোনা।'' ২০১০
দ্রস্টব্য যে ২০১০এর মে'তে 'বইয়ের জগত'এর তৃতিয় সংকলনে শহীদ কাদরীর শেষ প্রকাশনা 'আমার চুম্বনগুলা পৌছে দাও' রিভিউতে আব্দুল মান্নান সৈয়দ যে 'পত্রসাহিত্যে'র অবতারনা করেন, তাতে ১৯৭১ পরবর্তি সাহিত্য ইতিহাসের নামে কোন সেমিনারে, কোন টি, ভি অনুষ্ঠানে মান্নান কি বলেছেন সেসবের ফিরিস্তি থাকলেও; সামরিক সরকারের তত্ত্বাবধানে গঠিত 'কবিতাকেন্দ্রের' সংগঠনে নিজের ভুমিকা একেবারেই এড়িয়ে গেছেন!
ঘটনাক্রম মিলালে এ-সময়ের পরিসর হচ্ছে 'কবিতাকেন্দ্র' গঠনের পরে এবং এরশাদের পতনের পর!মান্নান বিভিন্ন রিভিউ এমনকি তার আত্মজিবনিতেও শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী সম্পর্কে এমনসব প্রসংগের অবতারনা করেছেন যেগুলার ক্রস রেফারেন্স করা প্রায় অসম্ভব!মান্নান এসব প্রসঙ্গে প্রবাসি কাদরীর সাথে তার বিভিন্ন ফোন আলাপ'কে রেফারেন্স হিশাবে দাড় করান!এটা সুবিুদিত যে 'কবিতাকেন্দ্র' গঠনের প্রত্যুত্তরে শামসুর রাহমান, কামরুল হাসানেরা যখন জাতিয় কবিতা পরিষদ গড়ে তোলেন তার পর থেকে আল মাহমুদ, মান্নানদের সাথে শামসুরের আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সামাজিক যোগাযোগ ছিলনা!
শহীদ কাদরীর যাপন ও উচ্চারন যত তাকে বাম প্রাগ্রসরতায় ঝোকা ব্যাক্তিক স্বাতন্ত্র বা মুর্ত অস্তিত্ববাদের কাতারে দাড় করিয়ে দেয়, মান্নান তত এটা খুড়ে, ওটা খুড়ে প্রমান করতে বধ্ব পরিকর যে শহীদের মনের টান আসলে কলা কৈবল্যবাদের বিমুর্ততার প্রতি!তার ওপরে সে-একই 'পত্রসাহিত্যে' শামসুরের কবিতাগুলা যে শুধ্বতাবাদের ওজ়োরে যথেস্ট পরিমানে মৌলিক নয় সে-আপত্তি!
২০১০এ ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক আহসানুল হকের কাছে দেয়া এক সাক্ষাতকারে, 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' কবিতা প্রসঙ্গে কাদরী বলেছিলেনঃ কবিতার মুল প্রবর্তনা কিভাবে রাজনিতির 'উচ্চকিত' প্রচারনা পেরিয়ে অবচেতনের মোচড়ে রুপান্তরিত হয় এবং পরস্পর বিরোধিতাকে ধারন করে!এখন অবচেতন মানে যে ইতিহাসের দায়শুন্য শুধ্বতাবাদ তা কিন্তু কাদরী বলে নাই! কাদরীর শেষ প্রকাশনা, 'আমার চুম্বনগুলো পৌছে দাও' এর রিভিউতে মান্নান যখন বলেন, "সুধীন্দ্রনাথ দত্তের( যার সঙ্গে শহীদ কাদরীর গভীরে কোথাও আশ্চর্য সাধর্ম্য আছে) 'সংবর্তের' পরে এরকম আত্মতাচিহ্নিত কবিতা দেখিনি আর"; তখন কি মনে হতে পারে না যে পঞ্চাশিও কবিতার নিজস্ব 'ভুল পাঠ'কে আবারো পেছনের দরজা দিয়ে সদরে ঢোকানোর ফিকির করছেন মান্নান!
ভুল পাঠ কেন?নিজের দক্ষিনপন্থি নান্দনিক আনুগত্যকে রাজনিতি-বিমুখতার আড়াল দিতে মান্নান বছরের পর বছর ধরে জীবনানন্দকে উদ্যেস্য-নিরপেক্ষ-শুধ্বতাবাদি বলে উপস্থাপন করেছেন!আর আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ, আবু হেনা মুস্তফা কামালদের আনুকুল্যে এই ধারনাই গ্রহনিয় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগগুলাতে!পরাবাস্তব আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রবর্তনাও এড়ায়ে গেছেন মান্নান!কারন সে-রাজনৈতিক প্রবর্তনার পথ ধরে পরবর্তিতে যে-অস্তিত্ববাদ তাতে কিছুতেই মান্নানের ধর্মিও-ভুডু আশ্রয় নিতে পারে না!এজন্যই তাকে বানাতে হয়, 'আত্মিকৃত রাজনিতির' মত শব্দবন্ধনি!
'আত্মচিহ্নিত রাজনৈতিক কবিতার' প্রচুর দৃষ্টান্ত মিলবে শামসুর রাহমানে এবং মৌলবাদি মনান্তর ঘটবার আগের আল মাহমুদে!স্যামসনের, টেলেমাকাসের প্রতিকি পর্ব পার হয়ে 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' এর সেই হোটেল রুমের অভিজ্ঞ্বতা!কাদরীর সতির্থদের ভেতর তুল্যমুল্যে না গিয়ে, সু্ধীন প্রসংগ এনে, 'দেখি নি আর' বলে নিজের পশ্চাদ্মুখিতাই প্রকট করেছেন মান্নান! বাংলাদেশের কবিতার প্রমিত পত্তনি যে স্বাতন্ত্র- সার্বভৌমে দাড়ায়ে আছে, তার আনুষাঙ্গিক প্রাগ্রসর আন্দোলনগুলাতেও নিজের অনুশিলিত-অনুপস্থিতিকে এভাবে আড়াল করবার প্রয়াস পেয়েছেন মান্নান!
শামসুরের কবিতা সম্পর্কে তার মৃত্যুর কিছুদিন পর আল মাহমুদের একটা মন্তব্যকে যথার্থ বলা যেতে পারে; মাহমুদ বলেছিলঃ 'রৌদ্র করোটির' পর রাহমান হেচকা টানে তিরিশিও প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছিলেন!মাহমুদ এও বলেছিলেন যে রাহমান তা করেছিলেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটাকে বাহন করে!শহীদ কাদরী'র বেলায়ও একই মন্তব্য শতাংশে যথার্থ!
বরকন্দাজেরাঃ
প্রয়াত কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন এবং ভ্রান্তিবিলাসি ক্যানভাসার সলিমুল্লাহ খান রাজনিতিকভাবে বিপরিত মেরুর হলেও কবিতা পর্যালোচনার ব্যার্থতাচিহ্নে এদের আচরন একই ধরনের!সলিমুল্লাহ যা না তা মিথ্যাচার ও অতিকস্টকল্পনার ঘোলা জলে শিকার করতে চান শামসুর রাহমান'কে; আর আশরাফের টার্গেট সেই মান্নান সৈয়দি কায়দায় শহীদ কাদরী!
বি, ডি আর্টসের শামসুর নিধনযজ্ঞে সলিমুল্লাহ খান বলছে 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটা শামসুর অনুবাদ করেছে দায় শিকার না করে পল এলুয়ার থেকে!বর্তমান লেখকের স্ত্রি ফরাসিনি হওয়ায় এবং ইংরেজিও ভাল জানায়; তার উপর বর্তমান লেখক চয়নও বাংলা, ইংরেজিতে দ্বিভাষি জিবনজাপনের গুনে একদিন শুভক্ষনে প্রচুর পল এলুয়ার ঘাটাঘাটি করেও সলিমুল্লার অভিযোগের কোন ভিত্তি পায় নাই!শামসুর রাহমানের 'স্যামসন' কবিতার সুত্রে তাকে যেভাবে ইহুদি তোষনকারি ও সাম্রাজ্যবাদের চর আখ্যা দেয়া হয়েছে সে-আলোকে 'জাতীয় কবিতা পরিষদের' সেমিনারে পড়া সলিমুল্লার প্রবন্ধ'টাকে সাম্প্রদায়িকতা অর্থে গ্রাম্য এবং অনৃতভাষন হিশাবেই চিহ্নিত করা শ্রেয়!আর সেখান থেকে পঞ্চাশের অবমুল্যায়নের সুত্রে পরবর্তি্তে আশির কবিতার ভাষা ও শৈলি বদলেরও অবমুল্যায়ন সম্ভব এবং অনেক ক্ষেত্রে তা হয়েছে।
হাজার বছরের টেলেমাকাসঃ
শামসুর রাহমান তার আত্মজিবনিতে বলেছেন যে স্যামসন, টেলেমেকাস জাতিয় আদি পৌরানিক চরিত্রগুলি দিয়ে তিনি বংগবন্ধুকেই বুঝায়েছিলেন!এ- প্রতিকগুলা নিয়ে শামসুরের কোন অবশেশান না থাকলেও শামসুর-বিদ্বেষি আহমদ ছফা এবং তার অনুসারিদের যে অবশেশান আছে তারও আচ পাওয়া যায় সলিমুল্লার প্রবন্ধটাতে!এরা শামসুর-আলোচনায় তার আত্মজিবনিটাকে সচেতনভাবে এড়ায়ে যায়!সলোমন ও দাউদ প্রাচিন ইস্রাইল গোত্রের লোক!সলোমনের গান খ্রিস্টানেরা গাইছে তাদের উপাসনায় নিয়মিত!সে-বাদেও কেউ এখন দাউদ'কে নিয়ে লিখলে ইসরায়েলের এজেন্ট হয়ে যাবে না কি?মহাভারত থেকে নিলে ভারতের চর? তাহলে বাকি থাকে কেবল আরব্য রজনির শেহেরাজাদের কাহিনি!বাহ!
আহমেদ ছফা অনুসারিদের কবিতা বিশ্লেষনের টেকনিক যেমনি অবশেশান আশ্রয়ি একদেশদর্ষিতা; তেমনি এই টেকনিক ব্যার্থ কবির সাথে মহৎ কবির সিমাসরহদ্দ চিহ্নিত করতে অপারগ!মহৎ কবি বহিরঙ্গের ভাষার সাথে অন্তরঙ্গের নিউরোলজিতে প্রতিকের পরম্পরা ধারন করে।অন্তর্গত প্রতিকের পরম্পরা যেমন সজ্ঞার সাথে তার বাস্তবতার সেতুবন্ধন, সেরকম প্রতিকের পরস্পর বিরোধিতার সাথে তাকে নিজের স্ববিরোধেরও একটা ভারসাম্য তৈরি করতে হয়!এখানে একাডেমিকেরা ব্যার্থ হয়ে যায় প্রতিকের পরম্পরা ধরতে না পেরে!বিকল্প লোকনকাচ হিশাবে এরা নেয় দর্শন নির্ভর যুক্তিকে!আর সে-যুক্তির চাপে সত্ত্বার যে সৎ ও সত্যিবোধ তা এদের চোখ এড়ায়ে যায়!যুক্তি-নির্ভর ব্যার্থ কবির একাডেমিক চর্চার সাথে ধর্মান্ধের পার্থক্য নাই বললেই চলে!
শামসুর সংশ্লিষ্ট এই প্রবন্ধটা নিয়ে আমি সম্প্রতি বিস্তারিত কথা তুলি কবিতা পরিষদের বর্তমান সভাপতি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সাথে, যেখানে তিনি পরোক্ষে স্বিকার করে নিয়েছেন যে ২০০৯এ 'জাতীয় কবিতা পরিষদের' মঞ্চ ব্যাবহার করে সাহিত্য সমালোচনার নামে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চালানো হয়েছিল!বটে, যেরকম মঞ্চ, সেরকম তার অবরোহন!
উত্তরাধিকারঃ
শহীদ কাদরী'র প্রথম কবিতা সংগ্রহ 'উত্তরাধিকার' নিয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেন তার 'কবিতার অন্তর্যামী' বইয়ে লিখলেন, "লে ফ্লার দ্যু মাল এর সঙ্গে শহীদ কাদরীর উচ্চারনের মিল এতটা প্রকট যে উত্তরাধিকার এর কবিতাগুলোকে মৌলিক বলতে বাধে!"
এখানে একটা ব্যপার লক্ষনিয়!বাংলা্দেশের কবিতাকে যে দুইজন জীবনানন্দ তথা তিরিশিও প্রভাব ছাড়ায়ে নিজস্ব নাগরিকতার প্রমিত পত্তনিতে দাড় করায়ে দিয়েছে সলিমুল্লাহ, খোন্দকার তাদের দুইজন'কেই তুলনা করেছে ফরাসি কবিতার তস্কর হিশাবে!আবারো ফরাসিনি অর্ধাঙ্গিনি প্যাট্রিসিয়াকে কথাটা জানালাম, বোদলেয়ার নিয়ে দুইজনে বসলাম!প্যাট্রিসিয়া বলে বসলোঃ তোমাদের কবি আমাদের কবি থেকে মেরে দিয়েছে, এরকমটা না বলেত বলা যায়, আমাদের বোদলেয়ার এলেন পো থেকে মেরে দিয়েছে!
খেয়াল করুন যে বোদলেয়ারের বেশির ভাগ সংগ্রহের মুখবন্ধ এলান পোর!এবার বুঝুন বোদলেয়ারের উপর এলানের প্রভাব!তার উপর এও শুনিনি যে এই দুই শিক্ষক ফরাসি ভাষায় লিখতে, পড়তে জানেন!বাংগাল'কে ফরাসি-হাইকোর্ট দেখানো আর কি!আমার দেখাতে একটা গোষ্ঠি বিভিন্ন বিপরিতমুখি স্বার্থ থেকে সচেতনভাবে বাংলাদেশের সাহিত্যের অর্জনগুলাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে!এদের স্পিনিং, ডক্টরিংযের লক্ষ্য প্রথমত বাংলাদেশের কবিতার পরম্পরাটা হয় নস্যাত করা, নয়ত দুর্বল করে দেয়া!এই প্রয়াসের মুল অভিপ্রায় হচ্ছে সাহিত্যের এবং সংস্কৃতিক প্রাগ্রসরতার ভুল পটভুমি তৈরি করা!পরম্পরাগত দুর্বলতা থাকলে এবং ভুল ইতিহাস তৈরি করা গেলে , আশির দশকে যে ভাঙ্গা লিরিক/খোলামিলের বিস্তার ঘটানো হয়েছে তাকেও এড়ায়ে যাওয়া সম্ভব শামসুর, শহীদ'দের অবমুল্যায়ন ঘটায়ে!
শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদকে নিয়ে আরো খোড়াখোড়ি হবে!শেষ কথাগুলার মোড় ঘুরবে বার বার প্রজন্মান্তরের পাঠকের হাতে!কিন্তু গোষ্ঠিস্বার্থ মেশানো ভুল ও বিকৃত পাঠের উতর চাপানগুলার মোকাবেলা হবে পথ চলতে, চলতেই!এটুকু বলা যায় এখনই যে পঞ্চাশের পর বাংলাদেশের কবিতাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই!
চয়ন খায়রুল হাবিব
১৮/০৮/১০
ব্রিটানি
শহীদ কাদরীর প্রয়ানে সামান্য পরিমার্জিত।আগের শিরোনাম ছিলো, 'শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর বিকৃত উপস্থাপনা''।চখাহা।২৯/০৮/১৬।ব্রিটানি।