Friday 11 June 2010

আনা কারেনিনা

রচনাটাতে ঈ, ঊ, ণ, চাদবিন্দু ও ছোট ত ব্যাবহার করা হয় নি!চখাহা।




কখনো আমাদের আত্মা ফুরিয়ে যায়, আমাদের দেহ ফুরানোর আগে! প্রাণস্পন্দন হয়ত দেহকে ব্যস্ত রাখে কবিতাবিহিন সামাজিকতায়!কথাসাহিত্যের বিশ্বগুরু রুশ উপন্যাসিক টলস্টয়ের অজরামর নায়িকা আনা কারেনিনা ছুটন্ত ট্রেনের তলায় ঝাপ মেরে আত্মহত্যা করেছিল।বাতসল্য ও প্রেমের দ্বন্দে যে দুর্বিসহ জিবনের ভার তার আত্মায় চেপে বসেছিল; সমস্ত বিত্ত, বৈভবের ভেতরে তা বহনের চেয়ে অবসানই জরুরি হয়ে উঠেছিল আনার কাছে!

কিন্তু ট্রেনের তলায় ঝাপিয়ে কেন? কেন হিরকচুর্ন নয়? সাপের বিষ নয়? সায়ানাইড নয়? বিষে, বিষে বিষক্ষয়ের মতই, আনা শেষ মুহুর্তে ঠিক করেছিল যে মহাযন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুতেই জাগতিক যন্ত্রনার অবসান হওয়া উচিত!যন্ত্র-না!শিল্পবিপ্লবের সাথে অস্তাচলগামি একটা সমাজের প্রতিকি বিরোধ!

টলস্টয় কি এখানে নির্বানের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন?এমনত হতেই পারে না যে টলস্টয় লাখ, লাখ শব্দের বুনটে যে মহাকাব্যিক নারি চরিত্রটিকে সাংসারিক টানাপোড়েনের ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্জে পরিনত করেছিলেন-হঠাত করে তার বিনাশের মত্ততায় খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন!আমরা এমন এক শ্রষ্ঠার কথা বলছি এখানে যার একটি গল্পের একটি শব্দকেও অন্যান্য ভাষার দুর্বলতমো অনুবাদেও বাহুল্য মনে হয় নি!

জার শাষিত রাশিয়ার উচ্চপদস্থ আমলা কারেনিনের স্ত্রি এবং সন্তানের জননি আনা এক অবিবাহিত বনেদি যুবকের প্রেমে পড়ে!আনা সে-যুবক ভ্রনিনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ছাড়াই আমৃত্য একত্রে থাকবার সিধান্ত নেয়!এই সম্পর্ক ছিল আদর, সোহাগ, পারস্পরিকতায় পরিপুর্ন!কিন্তু প্রেমিকের সাথে থাকবার সময় আনা চাইছিল তার বিয়ে থেকে জন্মানো সন্তানের লালনের অধিকার।কিন্তু প্রেমিকের বিত্ত এখানে কারেনিনের প্রভাবের কাছে হেরে যায়!সন্তানের লালন, পালনের বৈধতা অর্জনে আনা সর্বাংশে পরাজিত হয়!আনার আত্মহনন প্রায়শ্চিত্ত নয়!তার সময়ের এবং আবহমান পুরুষতন্ত্রকে ঝেড়ে লাথি কষবার সর্বোত্তম উপায় হিশেবেই টলস্টয় তার নায়িকাকে ট্রেনের তলায় ছুড়ে মেরেছিল!



নিয়রোলজিঃ

আত্মহননের এই ক্লাইমেক্স ছাড়া গল্পটির পিচ বা প্লট বলতে এটুকই যে- একজন বিবাহিত নারির এবং শিশুর মায়ের অন্য পুরুষের সাথে প্রেম!

কিন্তু এই প্লটটাকে অনন্যতা দিয়েছে প্রেম ও বাতসল্যের মেলবন্ধন!আর এই বাতসল্য বৈবাহিক বৈধতার শর্তাধিন নয়!অনুরাগও এখানে এককোষি বা স্বার্থপর নয়!দেহজাত প্রেমের আশ্রয়ি এই আনা তার সুদুর আত্মিয়া ট্রয়ের হেলেনের মতই আষ্ঠেপৃষ্ঠে পুরুষতন্ত্রের বন্দি!যৌনকলার বিভিন্ন আসনে পরিতৃপ্ত আনার অতৃপ্তিবোধের হেতু তার প্রেমাস্পদের সন্তান উতপাদনে অক্ষ্মতা!নারিবাদ এখানে আনার প্রতি বিরক্ত!কিন্তু নিউরোলজি নয়!

নিউরোলজি বলছে অন্যান্য জিবের মতই মানুষের সমস্ত যৌনাচারের পেছনে অবচেতনে কাজ করছে বংশবৃধ্বির প্রনোদনা!এককোষিদের বিভাজন প্রক্রিয়া থেকে মানুষ বংশবৃধ্বির সাথে সামজিক বিকাশের মাত্রা বাড়িয়েছে আদর, সোহাগ, প্রেম, ভালবাসার মাধ্যমে!কিন্তু পরবের পিঠার ওপরকার 'শুভ নববর্ষ', 'শুভ জন্মদিন', 'শুভ বিবাহ'  জাতিয় মনোহারি পরতগুলো উঠিয়ে নিলে পিঠাটির সারাতসার হচ্ছে শিশু উতপাদন!আর চেতনার এই পরতের সাথে বাতসল্য যোগ করেও মানুষ তার প্রজোনন'কে ভিন্ন করেছে এককোষিদের থেকে!



মোনালিসার হাসি ও জোডি ফস্টারঃ

জোডি বলছেঃ আমি সমকামি!আমি পুরুষের সাথে যৌনাচার করি না!একমাত্র অন্য নারির সাথেই আমি যৌনাচার করি!আমার দির্ঘমেয়াদি সম্পর্ক-সহযোগিনিও আছে!কিন্তু আমি গর্ভজাত সন্তান চাই!স্পার্ম ব্যাঙ্কের দৌলতে জোডি গর্ভধারন করেছেন, পুরো ৯ টা মাস বাচ্চা পেটে ধরেছেন এবং মা হয়েছেন!

অনেকে বলতেই পারেন যে তাহলে আর পেটে ধারনের দরকার কি ছিল?যারা নিয়মিত গাজা সেবন করেন তারা জানেন যে কল্কিতে পুরে গাজা সেবন যত তরিবতের, সিগারেটে পুরে ততটা মজাদার নয়!নিউরোলজি যে অবচেতনার কথা বলছে তার প্রসার ঘটাতেই জোডি হয়ত অজান্তেই এমনটি করেছেন!গর্ভধারনের বিশেষ হরমোনে টইটম্বুর হয়ে তিনি হয়ত মোনালিসার হাসিটি তার ঠোটে ধরে রাখতে চেয়েছেন; আর সমকামি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা আকার কথা মনে করে মিটিমিটি হেসেছেন!

আনা কারেনিনা, দাভিঞ্চি, মোনালিসা, জোডি ফস্টার- এই প্রবর্তনাগুলো মানুষের তৈরি সমাজের বিরুধ্বে মানুষেরই নান্দনিক, মানবিক হাতিয়ার!



আরব্য রজনি ও বাতসায়নের কামসুত্রঃ

আনা যে জার শাষিত রাশিয়ার নিগড়ে জিবনাবসান ঘটিয়েছিল, তা পুরাপুরিভাবে প্রভাবিত ছিল ফরাসি নেপোলিওনিক কদাচারে!ফরাসি বিপ্লবের সমস্ত অর্জনকে ঝেটিয়ে বিদায় করা ঐ সমাজের প্রিয় ব্যাসন 'আরব্য রজনি'! যার মুল অনুষংগ হচ্ছেঃ এক  পৈশাচিক সম্রাটের নারি বিদ্বেষ থেকে এক রাত্রির ভোগ এবং স্ত্রি কতলপ্রথা থেকে নিজের বোনকে রক্ষা করতে শেহেরাজাদির হাজার এক রাত্রির কাহিনি বুনোট!

চ্যানেল পারের ইংল্যান্ডের রাজ দরবারও আত্মিয়তার সুত্র বন্ধনেই য্যানো ঐ একই সমাজের ধারক বাহক!আরব্য রজনির সাথে ভিক্টোরিয়ান'রা যোগ করেছে বাতসায়নের কামসুত্র!এই বইগুলো নিয়ে ফরাসি, ইংরেজ নরপতিদের উতসাহই বলে দেয় ঐ সময় মেয়েদের জন্য কি ভুমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল!আরব্য রজনি আর বাতসায়নের প্রেস্ক্রিপশানের যোয়াল কাধে নিয়ে, কর্সেটে কোমর বেধে রমনির দায়িত্বই হয়ে দাড়ায় পুরুষের মনোরঞ্জনঃ হয় বিদুষি স্ত্রি, নয় পতিতা!লেডি চ্যাটার্লি, লোলিটা, আনাইস নিন'কে পথ দেখাতেই য্যানো আনা কারেনিনা ছন্দপতন ঘটালো বাতসায়ন নবিশ ই এম ফরস্টারের এডেলাদের আড়ষ্ঠ পুতুল নাচে!

আনাঃ সফোক্লিস থেকে সিলভিয়া প্লাথেঃ

নিজের অনুরাগ ও বাতসল্যকে দুই পুরুষের টানা পোড়েনের হাতিয়ার করে তোলা এবং সে-হাতিয়ারে ক্ষত, বিক্ষত আনার নিজস্ব কোন পেষা ছিলনা!এখানে টলস্টয়ের নায়িকা, সফোক্লিসের ভাগ্য বিড়ম্বিত নায়ক ইডিপাসের একযোগে মা ও স্ত্রি ইয়োকাস্টা এবং বাতসায়নের পুরুষ-কব্জাকলা-মন্ত্রে দিক্ষিত নায়িকাদের থেকে ভিন্ন নয়!

আবার পেষা এবং স্বাতন্ত্র্য স্বত্বেও বাতসল্য ও অনুরাগ জনিত ইর্শা মানুষ'কে কোন তলানিতে নিয়ে যেতে পারে, বিগত শতকে তার করুনতমো দৃষ্টান্ত হতে পারে ব্রিটিশ অন্যতমো প্রধান কবি টেড হিউজের প্রথম ও দ্বিতিয় স্ত্রির আত্মহনন!সি্লভিয়া প্লাথ আত্মহননের জন্য  বেছে নিয়েছিল গ্যসের চুলাকে!কিন্তু সন্তা্নদের রেখে এসেছিল টেডের কাছে!সি্লভিয়ার আত্মহননের আগেই টেড বসবাস শুরু করেছিল বিজ্ঞ্বাপন সংস্থার কর্মকর্তা আসিয়া ওয়েভিলের সাথে!কিন্তু সি্লভিয়ার আত্মহত্যার পর টেড আসিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়ে!আসিয়া প্রতিশোধ নিয়েছিল আরো করুন, আরো নিষ্ঠুরতায়!গ্যাসের চুলা ছেড়ে দিয়ে আসিয়া, টেডের ঔরসজাত কন্যা সুরা'কে নিয়ে বিছানায় যাবার আগে সমস্ত জানালা, দরজার কপাট বন্ধ করে দিয়েছিল!

তৃতিয় বিয়েতে টেডের অবস্য আর কোন ছন্দপতন হয় নি!সি্লভিয়ার ছেলে, মেয়েরা বড় হয়েছে তৃতিয় স্ত্রির কাছে!মানুষ ছাড়িয়ে পশুর অনুভুতি যে কবি ছুয়েছিলেন অতিমানবিয় মহিমায়; কাছের একান্তজনদের আত্মিক-আবেগজাত-বিস্ফোরন সে কবি ধরতে পারেন নি!এই যে মানবিক ত্রুটি বা FLAW তাই টলস্টয়ের মুল উপজিব্য!


পুশকিনের উত্তরাধিকারঃ

টলস্টয়কে কমিউনিস্ট'রা ব্যাংগ করত পাদ্রি বলে!মার্ক্সিস্ট সমালোচকেরা এই সৃষ্টিকে নাকচ করতে চেয়েছে, উচুতলার বস্তাপচা রোমান্স বলে!দস্ত্য়েভস্কি ঘোষনা করেছিলেন যে আনা কারেনিনার মত নিখুত, শিল্পসম্মত চরিত্র চিত্রন আর কখনো হয় নি!আরো পরে নাবোকফ দস্তয়েভস্কির প্রতিধ্বনি করে বলেন যে, আনার চরিত্রটাই সাহিত্যের আবহমান ভেল্কি, শ্বাশ্বতের চ্যালেঞ্জ!

টলস্টয় দেখা করতে গিয়েছিলেন পুশকিনের সাথে!সেখানে এক নজর দেখতে পান পুশকিনের বড় মেয়ে মারিয়া গার্টুং'কে!তারপর মারিয়া'কে দেখেছিলেন ঘুমঘোরে দিবাস্বপ্নে!জেগে ওঠে আনা প্রসঙ্গে প্রথম লাইন'টা লেখেন!পুশকিনের উত্তরাধিকারকেই কি টলস্টয় ট্রেনের তলায় ঠেলে দিয়েছিলেন?

চয়ন খায়রুল হাবিব
১১/০৬/২০১০
ব্রিটানি