Tuesday, 7 April 2020

রিফিউজি ব্লুজ




ধরো ঐ বড় বড় শহরে লক্ষ লোকের নিবাস
কেউ থাকে বড় দালানে কেউ বস্তিতে ছাড়ে দির্ঘশ্বাস
ঐখানে আমাদের ঠাই নাই
প্রিয়তমো, ঐখানে আমাদের ঠাই নাই

এক সময়ের চেতনা কাল পেরোলেও ন্যাজ্য
মানচিত্র আর ইতিহাসে পাবে ভাঙ্গাগড়া যত রাজ্য
এখন সেখানে যেতে পারি না আমরা
প্রিয়তমো, সেখানে যেতে পারি না আমরা

গ্রাম্য টিনচালা মসজিদে লতানো প্রাচিন এক কাঠালিচম্পা
মন্দির চাতালে ফোটে গুচ্ছ গুচ্ছ শম্পা
ন্যশনাল আইডিতে ফুটেনা সস্তিদায়ক ফুল
প্রিয়তমো, ন্যাশনাল আইডিতে ফুটেনা স্বস্তিদায়ক ফুল

বন্দুকের বাট চাপড়ে নগররক্ষিদের ঘোষনা 
আইডি নাই মানে গায়েবি জানাজার পরোয়ানা
কিন্তু আমরা এখনো জিবিত
প্রিয়তমো, আমরা এখনো জিবিত

মালিকের কাছে দৌড়ে গেলাম, তারা বল্লো ঐ পাশে সরে বসো
এ বছর হবে না আগামি বছরে এসো
কিন্তু আজকে আমরা যাবো কোথায়
প্রিয়তমো, আজকে আমরা যাবো কোথায়

ফেসবুক টুইটারে  লেখা পড়লাম
'ওদেরকে ঢুকতে দিলে, খাবারে টান পড়বে বলে রাখলাম'
ওরা আমদের কথা বলছিলো
প্রিয়তমো, আমাদের কথা বলছিলো

বাজের শব্দ থমকায় বিজলি চমকায় আকাশে 
'ওদেরকে মরতে হবে' বলছিলো অনেকে দানবিয় আক্রোশে
ঐ দানবের মিনিয়েচার আমাদের চারপাশে
প্রিয়তমো, মিনিয়েচার আমাদের চারপাশে

দেখলাম পোয়াতি বিড়াল একটা হাটছে হেলেদুলে
বনেদি পাড়ার দেয়াল ডিঙ্গালো সৈনিকদের পা গলে
কিন্তু  আমরা পার হতে পারলাম না
প্রিয়তমো, আমরা পার হতে পারলাম না

নদিতিরগুলোতে শুনলাম হারানো শুশুক সঙ্গিত
মনে হচ্ছে সাতার কাটছে অথচ জালে ধরা খাওয়া সম্বিত
মাত্র দশ ফুট দুরে
প্রিয়তমো মাত্র দশ ফুট দুরে

স্বপ্নে পেলাম ফাকা রাস্তায় পাখিদের কত শোভা
পাখিদের নাই চিকিৎসক পাখিদের নাই জনসভা
কারন পাখিরা মানুষ প্রজাতির নয়
প্রিয়তমো, পাখিরা মানুষ প্রজাতির নয়

উড়তে উড়তে হাজার তলা উচু এক আকাশ্চুম্বি ভবন
হাজার হাজার জানালা তার হাজার হাজার মহাতোরন
কিন্তু সে স্বপ্ন না কি আমাদের নয়
প্রিয়তমো, সে স্বপ্ন না কি আমাদের নয়

মুষলধারায় বৃষ্টিনিশুতি ছুয়ে হতবাক এক মহাপ্রান্তর
হাজারে হাজারে সৈনিক হাজারে হাজারে সাজোয়া বহর
তোমাকে আমাকে খুজছে
প্রিয়তমো, তোমাকে আমাকে খুজছে*

**অক্সিজেন মানুষের প্রাচিনতমো নেশা      
ভুমিদস্যুতা মানুষের প্রাচিনতমো পেষা
ভাসমান কাফনে আমাদের পরম যাপন
প্রিয়তমো, আমাদের পরম যাপন 

পাতালপুরির রক্ত এখন রক্তরঙ্গনে ভেসে***
খনিতল থেকে বস্ত্রশ্রমিকের ধমনিতে উঠে আসে
ওরা পৃথিবিপ্রাচিন খনিশ্রমিক
প্রিয়তমো, ওরা পৃথিবিপ্রাচিন খনিশ্রমিক 

মাটির গহিনে সেলাই মেশিনে**
ফিরলে পরে মনে হয় ভুতের জমজ
রাত্রির সন্তান ওদের দিবস গেছে চুরি
প্রিয়তমো, ওদের দিবস গেছে চুরি 

এই নাও যন্ত্রনা ও দুরত্বের পানপাত্র
এই নাও বন্দি মানুষের মুক্ত প্রেমপত্র
ভুতুড়ে অন্ধকারে কালবৈশাখি বার্তা
প্রিয়তমো, ভুতুড়ে অন্ধকারে কালবৈশাখি বার্তা  

তুমি বুঝতে পারো আমিও বুঝতে পারি**
সেলাই মেশিন নামছে খনির গহিনে
আদিবাসের সংগ্রাম স্বচ্ছতার সংগ্রাম
প্রিয়তমো, আদিবাসের সংগ্রাম স্বচ্ছতার সংগ্রাম

সংগ্রাম কি সাওতাল সংগ্রাম কি গারো**
সংগ্রাম কি জোনাকি পাঙ্খো না কি ম্রো
হাজং খেলে যায় লুসাই পাহাড়ের খ্যালা
প্রিয়তমো, হাজং খেলে যায় লুসাই পাহাড়ের খ্যালা

মুন্ডা পল্লিতে যদি খোড়ো খনিসুড়ংগ**
আদিকয়লাতে আকা খিয়াং নারিটির নাকছাবি তরংগ
ক্রমশ রাজবংশি মনিপুরি বিশ্বায়িত ইস্পাত
প্রিয়তমো, রাজবংশি মনিপুরি বিশ্বায়িত ইস্পাত

তামাটে বাংগাল বিয়ে করেছে নাকবোচা বর্মি কন্যাকে**
মুড়িটিন বাস হর্ন বাজায় গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রাস্তার বাকে
ফাকা রাস্তায় এখন কোনো বাসট্রাক নাই
প্রিয়োতমো কেনো বাসট্রাক কেউ কোথাও নাই

শ্রমদায়িনি কিশানি মায়ের গল্পে  
শিশুরা জেনেছে রুপকের দুয়োরানি বাচে খুব অল্পে
এই নাও সেই রুপক পানপাত্র
প্রিয়তমো, এই নাও সেই রুপক পানপাত্র   

পান করা মাত্র বুকে ধুকপুক ধানকাট্টির ভালোবাসা
মনপবনের উল্লাসে বোঝো এ দোচোয়ানি কত খাসা
একজন নয় এটা গাজিয়েছে বহুজন
প্রিয়তমো, এটা গাজিয়েছে বহুজন  

একটা ফোটা নয় বরং অনেকগুলো নদি
জননায়ক একজন নয় বরং জনতার প্রতিনিধি
সংগ্রামে সকলের মিলিত সম্মান
প্রিয়তমো, সংগ্রামে সকলের মিলিত সম্মান 

নদির পতন হলে ডুবে যাবো আমরা সবাই
নদিকে ধরবো যেভাবে গোলাপকে ধরে মরুর বস্রাই
তারপর যে ফুটন্ত নদি তা আমাদের প্রানাভা
প্রিয়তমো, তা আমাদের প্রানাভা

যদি তারা স্পর্ধা দেখায়ে ছুয়ে দেখে বুড়িগঙ্গার কপাল
সেখানে ধানকুটানিয়াদের মুঠিমুঠি রাশিরাশি তরতাজা লাল
রোগসংক্রমনে গোপন এক নিরোগ লোহিতভান্ডার
প্রিয়তমো, গোপন এক নিরোগ লোহিতভান্ডার***

দুক্ষকে যত সুক্ষভাবে বলি দুক্ষতো দুক্ষই**
সুইয়ে পরাই সুতা না কি সুতায় পরাই সুই
মসলিনের আয়নায় আমাকে কি দেখতে পাও
প্রিয়তমো, আয়নায় আমাকে কি দেখতে পাও

বাংলা অক্ষরগুলো যতবার পড়তে পাও**
আমার ঘরগুলো ততবার ভাসায় পালের নাও
আমার স্বরবর্ন হাসে কল্পকথার ক্যালিপ্সো ব্যাঞ্জনে
প্রিয়তমো, স্বরবর্ন হাসে কল্পকথার ক্যালিপ্সো ব্যাঞ্জনে

চয়ন খায়রুল হাবিব
৮/০৪/২০
ব্রিটানি, ফ্রান্স


প্রাককথন

চিলির স্প্যানিশভাষি কবি পাবলো নেরুদার, Cancion de gesta,  Poem for Fidel Castro(Song of Protest) এবং যুক্তরাজ্যের ইংরেজ কবি অডেনের  কবিতা  Refugee Blues  মিলিয়ে আমার গার্মেন্টস ক্যালিপ্সো!

১৯৩০এ অডেন তার কবিতাটি লিখেছিল ইউরোপে ইহুদিদের ওপর নির্জাতন নিয়ে।নেরুদা তার কবিতাটি লিখেছিলো ১৯৬৬সালে।নেরুদার কবিতাটিকে ফিদেলের প্রতি অর্ঘ্য না বলে জবাব বলা যায়।মনেপ্রানে এবং সক্রিয়ভাবে সমাজতন্ত্রি রাজনিতির অনুসারি নেরুদাকে ফিদেলের অনুসারি কিউবার বেশ কিছু বুদ্ধিজিবি একত্রে সংস্কারপন্থি বলে আক্রমন করে একটি সাক্ষরিত চিঠি কিউবাতে ছাপে এবং নেরুদাকে তার পথ থেকে সরে ক্যাস্ট্রোর পথে আসতে অনুরোধ জানায়।কিউবার কোনো কোনো বুদ্ধিজিবি এ চিঠি সাক্ষর থেকে বিরত থাকে।চিঠিটি কিউবার কমিউনিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৬র জুলাইয়ে।নেরুদা বুঝতে পারে যে তার মার্কিন যুক্তরাস্ট্র সফর কেন্দ্র করে ফিদেলের নির্দেশে এটা ঘটেছে।সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে একই বছরের অগাস্ট মাসে নেরুদা উল্লেখিত কবিতাটি লেখেে।নেরুদার প্রতি সাক্ষরিত ঐ চিঠিটিকে তখনকার অনেক সমাজতন্ত্রি ও কমিউনিস্ট লেখক অন্যাজ্য অভিযোগ বলে অভিহিত করে।চিঠিটির আগে নেরুদা বিপ্লোবোত্তর কিউবাতে গেলেও, এর পর আমন্ত্রন সত্বেও আর কিউবাতে যায় নাই।

অডেনের কবিতাটার শিরোনামের Blues শব্দে  এর ছন্দরিতি নির্দিষ্ট করা আছে।একই সময় অডেন আরো কিছু কবিতা লেখে এই ভঙ্গিতে, যার ভেতর   তার বিখ্যাত প্রেমের কবিতা 'ক্যালিপ্সো'ও আছে!যেহেতু এই কবিতাগুলোর ছন্দরিতি পশ্চিমের মিটার বা পুর্বের বৃত্তবদ্ধতা অনুসরন করে নাই, অডেনের ক্ষেত্রে এই পর্বটিকে ক্যালিপ্সো-ভঙ্গি নাম দেয়া যেতে পারে! নেরুদার লেখাটি গদ্যছন্দে!আমার আখ্যানে আগাগোড়া পুনরাবৃতিমুলক Blues ভঙ্গি বজায় রেখে, নিজস্ব 'ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ানের' পরিধি বিস্তারেরও চেষ্টা চালিয়েছি।

১৯শতকের শেষ দিকে এমেরিকার প্রত্যন্ত দক্ষিন অঞ্চলে Blues গিতল ধারাটি বিকশিত হয়।এর শিকড়ে আছে আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহি সঙ্গিত, আফ্রিকান এমেরিকান শ্রমজিবিদের সংগিত ধারা এবং ইউরোপিয়ান এমেরিকান লোক সঙ্গিতের ধারা! Blues এর প্রভাব পাওয়া যাবে জ্যাজ, রিদেম এন্ড ব্লুজ এবং রক এন্ড রোল ধারাতে।চ্যান্ট বা মন্ত্র বা ঝিকিরের ভঙ্গিতে মেঠো বুলি এবং বর্ননামুলক গাথার ভঙ্গি মিশিয়ে Bluesএ আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করা হয়।সুনির্দিষ্ট স্বরলিপি নির্ভর স্তবকগুলোতে পুনরাবৃতির মাধ্যমে ট্রান্স এবং গ্রুভে Groove এর আবেশ ছড়িয়ে দেয়া হয়।  

নেরুদার মুল অনুষংগ খনিশ্রমিক, মদ প্রভৃতি রেখে দুটি কবিতার অন্তস্রোতা সাযুজ্য ও প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থে শব্দার্থ কিছুটা অদলবদল করার পোয়েটিক লাইসেন্স প্রয়োগ করেছি!লাল আঙ্গুরের মদকে করেছি ঢাকাই ধানকাট্টি, সেলাই মেশিন অডেন, নেরুদার কবিতায় নেই, সেটা এনেছি, ফেসবুক, টুইটার যোগ করেছি।কয়েক বছর আগে এ অবলম্বিত কবিতাদ্বয় দিয়ে সাওতাল ও রোহিঙ্গাদের ওপর অনাচার ধরবার চেষ্টা করেছিলাম।আদিবাসের সে প্রসংগটি আরেকটু বাড়িয়েছি।করোনা লকডাউনের সময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের ফিরে আসা এবং আবার ঢাকা ত্যাগের পর লেখাটির আরো বড় ক্যানভাসটি আমার পাঠে ধরা পড়ে।আরো কিছু যোগ, বিয়োগ করি।আবহে মুলত ক্যালিপ্সো।নেরুদার ছড়ানো গদ্যগন্ধি গিতলতাকেও ক্যালিপ্সোতে বেধেছি।এক অর্থে তিন ভাষার তিন প্রজন্মের তিন কবির কথপোকথনের ক্যালিপ্সো এটি।অতিরিক্ত প্যারা, কোথায় অডেনের অংশ, কোথায় নেরুদার অংশ, কোথায় আমার অংশ তারকা চিহ্নিত করে দিয়েছি!চয়ন খায়রুল হাবিব/৪ এপ্রিল, ২০২০/ব্রিটানি, ফ্রান্স

 *অডেনের রিফিউজি ব্লুজ অবলম্বনে
** মৌলিক প্যারা।
***এ অব্ধি নেরুদার কবিতা অবলম্বনে

অনুবাদের বিভিন্ন অংশ আমার 'বাঙ্গালির পরিচয় কাব্য' দীর্ঘ ্কবিতায় ব্যাবহার করেছি।চখাহা।


Photography from the coreography, 'Made In Bangladesh' by Helena Waldmann and Vikram Iyengar
Photography by Taslima Akhter, Rahul Talukdar,Margi Geerlinks

Blog Compillation Copyright, Translation Copyright, Choyon Khairul Habib
Poetry by Choyon Khairul Habib