Friday 6 April 2018

সালমানকে সল্লু মিয়া বলা কি সাম্প্রদায়িকতা?

কিম্বা পরিবেশবাদি অমৃতা দেবি  কথকথা : ২০ বছর আগে শুটিং এর সময় রাজস্থানে বিপন্ন কালো হরিন শিকারের অপরাধে, বিশ্নোই সম্প্রদায়ের দায়েরকৃত মামলায়, যোধপুরের আদালতে সালমান খানের যে ৫ বছর কারাদন্ড হয়েছে, আর সালমান দন্ড খাটাকালিন জামিনের আপিল করতে যাচ্ছে তা সবার জানা।

মুম্বাইর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সালমান ঘিরে বিলিয়ান রুপি লগ্নির অনিশ্চয়তা নিয়েও যে চিন্তিত তাও খবরে এসেছে।মুম্বাইর শিল্পি মহলের নেতৃস্থানিয় জয়া বচ্চনসহ অনেকে এ দন্ডাদেশের বিরোধিতা করেছে, তাও বাসি।সালমানের বিরুদ্ধ্বে ২০ বছর আগে প্রকৃতিজিবি যে বিশ্নোই সম্প্রদায় কালো হরিন ও চিঙ্কারা শিকারের অভিযোগ এনেছিল, তারা কারা, কেন তারা জিব রক্ষাকে ধর্ম মনে করে, জিবহত্যাকারিকে ধর্মনাশি ভাবে, তার মর্মে যাবার চেষ্টা আমাদের পরিবেশবাদি আন্দোলনগুলোকে বেগবান করবে বৈ কি।

বিশ্বের বিভিন্নভাষি ছবির সাথে প্রচুর বলিউডি ছবি দেখলেও সালমানের আমি বিশেষ ভক্ত না।তার কোন ছবির নাম বলতে পারবো না।আবার এমনও না যে বলিউডি কমার্শিয়াল আমার ভাল লাগে না।তাল  সিনেমাটা মুক্তির পর পর দেখেছিলাম জয়পুরে পিঙ্ক প্যালেসে ১৯৯৯সালে!এক যুগ পরেও তার গান, নাচ, মেকিং এ মুগ্ধতার রেশ এত টুকু কাটে নাই।ইয়াহান, তামাশা, হাজারো খোয়াইশি আইসি, স্লাম ডগ ডুয়েলার্স, ইয়ে জাওয়ানি হায়  ইত্যকার বিচিত্র বলিউডি ছবি আমাকে টানে প্যাডম্যান, টয়লেট লাভ স্টোরির পাশাপাশি।ক্যাটরিনা কায়েফের চিকনি চামেলি গান, সালমান ও জারিনের ক্যারেকটার ঢিলা হায়  আলাদা করে বার বার শুনে মজা পাই,। কিন্তু ঐ মজাটুকু ছাড়িয়ে সালমানের পুরো একটা ছবি আমাকে টানে না।সেটা তার ব্যাড বয় ইমেজের কারনে নয়।র‍্যাম্বো ধরনের ছবি আমাকে টানে না।সেটা খান বা শিং কাকে দিয়ে হলো তা আমার বিবেচ্য না।
বিশ্নোইরা কৃষ্ণসার বা কালো হরিনের রক্ষক হিসেবে মনে করে নিজেদের। সালমানের জিপসির নম্বর পুলিশকে তারাই দিয়েছিল।বন্যপ্রাণ আইনে ২০ বছর ধরে মামলা তারাই চালিয়েছে।বাংলাদেশে যেরকম সঙ্খ্যালঘু বিশ্নুপুজারি বিশ্নুপ্রিয়া মনিপুরি সম্প্রদায়, সেরকম না হলেও বিশ্নোইরাও বিশ্নুপুজারি। ১৪০০ শতকের গুরু জাম্বেশাওয়ারের অনুসারি বিশ্নোইরা ১২০ শব্দে সিমিত যে ২৯টি আচার মেনে চলে তার পুরোটার ভিত্তি হচ্ছে অহিংসা নিতি ও জিবরক্ষা।তাদের চর্চায় কালো হরিন মারা এবং গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ মারা একই কাতারভুক্ত, যাতে সালমান অভিযুক্ত।আবার বিশ্নোইদের মত হাজারো সম্প্রদায় আছে ভারতে যারা নিজেরাও বিভিন্ন প্রকল্প, সরকারি নিতির ফলে বিপন্ন।এরকম একটা সম্প্রদায়ের মহিলারা উলংগভাবে দিল্লির বড় প্রশাষনিক ভবনের সামনে প্রতিবাদ করেছিল এরকম বলে যে ভারতিয় সেনাবাহিনি তাদের নিয়মিত ধর্শন করছে।সালমান খান তুমুল সুপারস্টার হবার কারনে যে মামলা ২০ বছর ধরে ঝুলে থেকেছে, তাও নয়।ভারতে এরকম হাজার হাজার মামলা যুগের পর যুগ ঝুলে আছে।একদিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আরেকদিকে আর্থিক বৈষম্যের প্রভাবতো থাকছেই।সেটা কালো হরিন শিকারের মামলা হোক বা  অমিতাভ বচ্চনের প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করা বোফোর্স অস্ত্রক্রয় মামলা যাই হোক।
এর ভেতর সল্লু মিয়া  ব্যাপারটা কি?দেখলাম কোলকাতার এক সাংবাদিক ভদ্রলোক সালমানকে অপর পশ্চিমবঙ্গিয়দের মতো সলমন লিখে সল্লু মিয়া  বলছে এবং তার নিচে অপর সনাতন ধর্মিরা হরিবোল, হরিবোল করছে।কিছুদিন আগে  হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বাংলাদেশের একটা  সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা মনে এলো, যেখানে সরকারি এক মন্ত্রি হিন্দু না বলে মালাউন  শব্দটা ব্যাবহার করেছিল।এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর হৈ চৈ হয়, অনেকে প্রোফাইল ছবিতে লটকে দেয়, আমি মালাউন।এখন তাহলে কি কোলকাতার এই সাংবাদিক মহোদয় আক্ষায়িত সল্লু মিয়া  আমরা আমাদের প্রোফাইলে লটকে দেব?এই সল্লু মিয়া  বা মালাউন  জাতিয় শব্দগুলো রঙরসে সিমিত থাকতো যদি না উপমহাদেশে পর ধর্মের প্রতি বিশোদ্গার, সহিংষতা সামাজিক মহামারি থেকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিনত না হতো।স্মর্তব্য যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক  সাবেক বিচারপতি  সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিশ্নপুরি মনিপুরি সম্প্রদায়ের।সরকার যখন তাকে অবসরে যেতে বাধ্য করে তখন কোন কোন মহল যেরকম সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ এনেছিল, সেরকম সালমান খানের বিলম্বিত দন্ডকেও অনেকে সাম্প্রদায়িক মনে করছে।বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে উপমহাদেশের মুল ধারার ক্ষ্মতাসিনেরা জনতাকে সাম্প্রদায়িকতায় প্ররোচিত করবার কারনই এই মনে হবার পেছনের মুল কারন।
সালমানকে যারা সলমন বা সল্লু মিয়া ডাকছে, দেখা যাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি বিভৎস অবিচারকে না দেখে তারা মুসলিম পরিচয়টাকে সামনে এনে দেখছে।সালমান খানকে যারা সল্লু মিয়া ডাকছে কোলকাতার মেহেদিবাগের বেধড়ক গরিব বিহারি মুসলিমদেরও কি তারা কোন অপনামে ডাকে? উপমহাদেশিওরা পাকিস্তান থেকে আসুক আর না আসুক, ঘরোয়াভাবে ব্রিটিশ গোরাদের কাছে তারা পাকি।ইহুদিদের নিয়েও এরকম অনেক অপনাম আছে।দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিদের বিরুদ্ধে অপনাম, বিশোদ্গার করা যাবে না বলে আইন পাশ করা হয়েছে দফায় দফায়, যার আওতায় রাজনৈতিক দল, তথ্য ও শিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধি সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।কট্টর হিন্দুত্ববাদি জঙ্গিদের হাতে হিন্দু উদারনিতিক বুদ্ধিজিবিদের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডগুলো, বাংলাদেশে ভিন্নমতাবলম্বি লেখক, প্রকাশকদের একের পর এক হত্যা বলে দেয় যে ভারত, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের আরো সচেতন হওয়া দরকার সাম্প্রদায়িকতা রোধের আন্দোলনে।এখানে পাকিস্তানি ব্যার্থতাকে ঢাল হিশেবে ব্যাবহার করলে ভারত তার বহু বর্নিল সংস্কৃতির ভিত্তি ও আস্তর হারাবে একসাথে।
মনে রাখা দরকার, বন্যপ্রানি সংরক্ষন ধারনার আদি অনুশিলক বিশ্নোই সম্প্রদায় সালমান খান মুসলিম না কি তারকা না কি ধনাঢ্য সে হিসেবে তার পেছনে লাগে নাই।সতেরোশো শতকে যোদপুরের মহারাজা অভয় শিং তার সৈনিকদের বিশ্নোই অঞ্চলের কাছাকাছি খেজরি গাছ কাটার নির্দেশ দিলে কিম্বদন্তিখ্যাত  গ্রামিন বধু অমৃতা দেবি  তাতে  বাধা দেয় গাছের সাথে মরনপন নিজেকে জড়িয়ে  ধরে।মহারাজার সৈনিকেরা অমৃতা দেবিকে হত্যা করলে শত শত বিশ্নোই ছুটে এসে গাছ জড়িয়ে ধরে।রাজার সেনারা করেকদিনের ভেতর ৩০০শর বেশি বিশ্নোইদের হত্যা করে।পরে রাজা এসে বিশ্নোইদের কাছে ক্ষমা চেয়ে গাছকাটা বন্ধ করে।গাছ রক্ষার জন্য সে আত্মত্যাগের স্বিকৃতি স্বরুপ ভারত সরকার অমৃতা দেবি স্মারক প্রুস্কার দিয়ে থাকে।এই আত্মত্যাগের ধারক হিশেবে বন্যপ্রানি সংরক্ষনের চিপকো আন্দোলনের  সুত্রপাত হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সিমান্তবর্তি যশোর রোডের সম্প্রসারনের নামে  শত বছরের প্রাচিন মাহগনি নিধনের যে সিদ্ধান্ত হয়, কিম্বা সুন্দরবনের কাছে রামপালে যে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মানাধিন, এসব রুখতে নিসন্দেহে বিশ্নোই সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত অনুসরনযোগ্য।

  
চয়ন খায়রুল হাবিব
৭।০৪।১৮
ব্রিটানি