Thursday 8 February 2018

ভাষা : ইউজার ফ্রেন্ডলি বনাম হুমকি প্রেমিস

চিত্র, এমি জুড
জুলেখা সিরাপ এডমিন থেকে তৃণা রাব্বানি ভাষার মাসে ভাষা নবায়নি   শিরোনামে ৫টা লিঙ্ক দিয়েছেন।সেগুলো পড়ে শাহাব আহমেদ নিবিড় যে মন্তব্যগুলো করেছেন, তার সবগুলো আরো আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি করে।   
 
Shahab Ahmed তথ্যবহুল প্রতিবাদী দীর্ঘ লেখাটি ( প্রতীকের দেশী, বিদেশী, আদিবাসী , রামকিঙ্কর বেইজের সাঁওতাল পরিবার....) পড়লাম মনোযোগ দিয়ে।খুব ভালো লাগলো।লেখককে ধন্যবাদ।
 
Shahab Ahmed শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকারের লেখার বক্তব্যের সাথে সহমত। যেখানে গ্রহনযোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে সেখানে “ঘন্ট বাংলা” বা বাংলিশ ব্যবহার না করার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কিছু ইংরেজী শব্দ রয়েছে (বিশেষ করে পেশাভিত্তিক) যাদের বাংলা প্রতিশব্দ নেই ,সেক্ষেত্রে সে শব্দ বাংলায় আসতে পারে অবশ্যম্ভাবী ভাবে কিন্তু পরিবেশন হওয়া প্রয়োজন সচেতন ও স্বতস্ফুর্ত, যাতে রবীন্দ্রনাথের মতে “অন্যের কেদারার হাতলের উপর বসার” মত না হয়।অন্য ভাষার শব্দ গ্রহণে দোষ নেই, দোষ অশালীনভাবে গ্রহণ করায়।
 
Shahab Ahmed মোহাম্মদ ইরফানের “ভাষা বৈচিত্র ভাষা ব্যাবধান “ পড়লাম। খুবই তথ্যবহুল লেখাটি। ইংরেজী ভাষার অর্থনৈতিক শক্তি বিশ্বের অন্যান্য ভাষার জন্য যে কতখানি হুমকি তার একটি বাস্তব ধারণা দেয়া হয়েছে।লেখককে ধন্যবাদ।
 
আমাকে জানানো ধন্যবাদটুকু আন্তরিকভাবে গ্রহন করে এবং ভাষা নিয়ে লেখা অন্যদের শ্রমসাধ্য আয়াসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি এ আসরে শালিন, অশালিনের আপেক্ষিকতা এড়িয়ে ইরফানের প্রেমিস ও শাহাবের মন্তব্য নিয়ে কিছু লিখবো ঈ, ঊ, ণ, চাঁদবিন্দু এড়িয়ে।এর অর্থ নয় যে ইরফানের সাথে আমি পুরো দ্বিমত।কিম্বা পবিত্র সরকারের সাথে একমত।এটুকু বোঝাতে যে ইরফানের লেখা ও শাহাবের মন্তব্যগুলো বিশদে পৌছাবার দাবি রাখে।
 
শাহাবকে আমার উত্তর :
 
সুজনেষু শাহাব, 
 
'হুমকি' প্রেমিসটা কি পুরোপুরি নেয়া যায়?ইউজার ফ্রেন্ডলির ব্যাপারটা?ভাষাভিত্তিক সম্পদের তথ্য, উপাত্ত অনেক দিলেও কথিত বামদের প্রিয় শব্দগুলো অর্থাৎ হুমকি প্রেমিসটার সাথে যেসব ইউসুয়াল সাস্পেক্ট জাতিয় তকমা লাগানো হয়  সেগুলো ইরফান কম বা একেবারে ব্যাবহার না করে আমার ধন্যবাদার্হ।হুমকি প্রেমিসের লাগোয়া অনুষংগ এবং ইতিহাস বিবেচনায় আনলেও ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসটা নিতে হয়।
 
আমাদের পঠিত ইতিহাসে স্প্যানিশ, ফরাসি, আরবি, ইংরেজি, রাশিয়ান ইত্যাদি বিভিন্নভাবে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, অন্য ছোট ভাষা খেয়ে দিয়েছে।ইরানিরা আরবিদের ধর্মের মুখে নিজেদের ধর্ম হারিয়ে ফেললেও ফার্সি ভাষাটা প্রবলভাবে ধরে রেখেছে।আবার ওদিকে আফ্রিকাতে আরবি চাপে স্থানিয় অনেক ভাষার সাহিত্য লাপাত্তা।হুমকি প্রেমিসের অনুষংগ নিলে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি লোকের মোংগলিয়ান ভাষাতে কথা বলার কথা, কিন্তু তা হয় নাই।অথচ মোংগলরা রাশিয়া দখল করেছিল ৪০০ বছরের উপর, চিনে ও ভারতে শত বছরের উপর রাজবংশ বিস্তার করেছিল, সম্পদ উপাত্তেও মোঙ্গল পরিবারদের বেশি সম্পদ ছিলো।মধ্য এশিয়াতে একের পর এক জনগোষ্ঠি মোংগোল বংশদ্ভুত হলেও বিশ্বভাষায় তা কোন প্রভাব রাখতে পারে নাই।একই অবস্থা হয়েছে অটোমান তুর্কি ভাষার।
 
যে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র ও দক্ষিন এমেরিকাকে নিউ ওয়ার্ল্ড বলা হয়, সেখানে কলোনিয়াল ফাইট বা সম্পদ আহরনের ফাইটটা ছিলো স্প্যানিশ, ফরাশি ও ইংরেজের ভেতর।কিভাবে য্যানো পর্তুগাল ব্রাজিল পেয়ে গেলো।কিন্তু ইংরেজ থেকে স্বাধিনতার পরেও উত্তর এমেরিকার মিশ্র অভিভাষিদের কমন ভাষাতে চলে এলো ইংরেজি; স্প্যানিশও বহুল ব্যাবহৃত হলেও  তা উচ্চতর শিক্ষাদিক্ষায় তেমন ব্যাবহৃত না। আবার ল্যাটিন এমেরিকা পুরোটাই স্প্যানিশ ভাষি, ভাষা হুমকি সেখানে কি আছে জানা নাই, কিন্তু সম্পদ ব্যাবস্থাপনায় একটা মেস।ব্রাজিলও সম্পদ ব্যাবস্থাপনায় আরেক মেস।আর এদের কমন ডায়ালগ, মার্কিন আগ্রাসন ইত্যাদি।সেটা যে নাই তা না।তবে ইউজার ফ্রেন্ডলি প্রেমিসটা এড়ানো ঠিক না।নেয়া কমায় দিলে, দেয়াটাও কমে।
 
সোভিয়েটের সাম্রাজ্য ছিলো, প্রযুক্তি ছিলো, প্রচুর অনুবাদও তারা করতো।কিন্তু ওয়ারশ প্যাক্ট ভাঙ্গার পর সাবেক সোভিয়েট সবাই আর রাশিয়ান ভাষার প্রতি তেমন উতসাহি না।চিনারাও আফ্রিকাতে প্রযুক্তির নামে ভুমি আগ্রাসন চালাচ্ছে তিব্বতের মত, কিন্তু ভাষাটা তেমন জাকিয়ে বসতে পারছে না।আমাদের দেশের দিকে তাকান, আরবির চল কিন্তু অনেক কম থাকতো যদি মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের বাজার না থাকতো।আবার আমাদের দেশে কোরিয়ানেরও কোচিং সেন্টার আছে শ্রমের বাজারের সম্পর্ক হিসাব করে।এগুলো ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসের ব্যাপার।
 
ইংরেজি ভাষাভাষি অঞ্চলের সম্পদগত উপাত্তের সাথে সাম্প্রতিক সন্দর্ভগুলোতে আমি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাস্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক তুলনামুলক আলোচনা আশা করবো।বিশেষ করে জাতিয়তাবাদি ও গ্লোবালাইজেশান বিরোধিতার ঝিকির তুলে যুক্তরাজ্যের ইয়োরোপিয় অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসা।যারা বেরিয়ে আসতে যুক্তরাজ্যের বিশেষ করে ইংল্যান্ডের সঙ্খ্যাগুরু ভোটারদের উস্কে দিয়েছে, তারা তাদের নেতিবাচকতার ফর্দে বার বার বলেছে যে, ইয়রোপিয় আর্থিক অঞ্চলে থাকলে তাদের সম্পদগত লোকশান হচ্ছে।এটা তারা করেছে, নিজেদের অভিবাসি বিরোধি বর্নবাদ ঢাকতে।যদিও এই সম্পদগত লোকশানের হিশাবটা ছিলো আকাট মিথ্যাচার, তার পরও ইয়রোপিয় কমিউনিটি বার বার বলেছে যে এটা শুধু একটি লাভ, লোকসানের অর্থিক অঞ্চল নয়, বরং সাংস্কৃতিক, মানবিক, রাজনিতিক মেলবন্ধনের অঞ্চলও।ইউরোপিও কমিউনিটি হচ্ছে একসাথে জাতিয়তাবাদ বিরোধি, ফ্যাশিবাদ বিরোধি, যা তাকে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের পাশবিক জাতিয়তাবাদি আবহ  থেকে বের করে এনেছে, মৃত্যুদন্ড সামগ্রিকভাবে রদ করে ব্যাক্তির জিবনের মুল্যকে রাস্ট্রের উপরে নিয়ে গেছে।স্ববিরোধিতা এ অঞ্চলে আছে, তা সিরিয়ার অভিবাসিদের কেন্দ্র করে দেখা গেছে।কিন্তু সে স্ববিরোধিতা আরবিভাষি অঞ্চলের বৈশম্যের সামনে এখনো ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।
 
ইউগোস্লাভিয়ার পতনের পর বলকান ভাঙ্গনে, সোভিয়েত পতনের পর বোঝা গেছে কমিউনিস্টেরা খাতাকলমে সমাজতন্ত্র করলেও, অনুশিলনে জাতিয়তাবাদের ইন্ধনকে জিয়ায় রেখেছিল, কিম্বা জবরদস্তি করতে গিয়ে একে কার্পেটের নিচে চালান করেছিল সমস্ত বিষবাস্পসহ।এখন এসব প্রবনতা ভাষাতেও প্রভাব ফেলে।গতকালকের বহির্মুখি ইংল্যান্ড আজকে অন্তর্মুখি, যাতে যুক্তরাজ্যের শরিক হয়েও স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যন্ড রাজনিতিকভাবে রাজি না।সম্পদের বাইরে এসব বিচ্ছিন্নতাবাদি প্রবনতা, ভাষা ও ভাষাভাষি ব্যাক্তিকে কিভাবে সাংস্কৃতিকভাবে অন্তর্মুখি ও সঙ্কুচিত করে ফেলে তা ইরফানের লেখায় একেবারে আসে নাই।যেহেতু সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি সুপার পাওয়ার ইংরেজ ভাষি এবং চলমান ইতিহাসের একমাত্র সুপার পাওয়ারও ইংরেজ ভাষি,  এ দুটোর প্রবনতাগত পার্থক্যগুলো দরকারি।তবে উন্নয়নের সুচক, যাপনের মানের সুচক কেন্দ্র করে ভাষাভাষিদের সামাজিক শক্তির ব্যাবধানের যে চিত্রটি ইরফানের লেখায় এসেছে, তা কিছু ক্ষেত্রে হুমকি ছাড়িয়ে সরাসরি না হলেও ইউজার ফ্রেন্ডলি সুচকেরও পরোক্ষ সমর্থন দেয়।     
 
কোমল বা কঠিন যে হুমকির মুখে ভাষা চাপানো হোক, একটা সময় তা বুমেরাং হয়।ফরাশি ভাষা পরিশিলনে, দেয়ানেয়াতে অনেক এগোনো থাকলেও এখন বেশ সঙ্কুচিত।আফ্রিকাতে অনেক শহর আছে যার ফরাশিভাষি প্যারিসের চেয়ে বেশি, কিন্তু হতদরিদ্র।নাইজেরিয়ার গুরুভাগ ইংরেজভাষি, কিন্তু সম্পদ ব্যাবস্থাপনায় মেস।আবার বেলজিয়াম অফিসিয়ালি ৪ ভাষা চালাচ্ছে, কিন্তু ব্যাবস্থাপনায় টপ।বাংলাদেশিদের সাথে হিন্দির সম্পর্ক সিনেমার মাধ্যমে।সেটাকে একজন দেখবে আগ্রাসন, আমি দেখি ইউজার ফ্রেন্ডলি প্রেমিস থেকে।কোলকাতা ব্রিটিশের রাজধানি হবার সুবাদে, হিন্দির চেয়ে বেশি সুজোগ পেয়েছে দেড়শো বছর।অনেক আদিবাসি সমাজ বাংলাকে নিয়েছে, তার সাথে নেয়ার চেয়ে দেয়ার খতিয়ান বড়।দার্জিলিং এর নেপালিদের সাথে বাঙ্গালির সম্পর্ক সম্পদ কুক্ষিগত করবার ফাশদড়িতে বাধা, একই সম্পর্ক বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায়।
 
বাংলা বিশ্বজনিন ফন্টের অভাবটাও ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসকে আটকে দেবার সামন্ততান্ত্রিক, কায়েমি, স্নবারিতে বাধা।সবচেয়ে ইউজার ফ্রেন্ডলি বাংলা ফন্ট হচ্ছে মেহেদি হাসানের অভ্র ইউনিকোড।কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের বাজার দখল করে আছে আনন্দবাজারি ফন্ট, আর বাংলাদেশের বাজার দখল করে আছে মুস্তাফা জাব্বার সাহেবের বিজয় ইত্যাদি, যার পক্ষে হাইকোর্টের ইঞ্জাংশানও আছে, মিডিয়া তা নিয়ে বলে না।
 
ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসে সস্তার তিন অবস্থার টিশার্ট থেকে বইমেলা সয়লাব করা কথিত সাহিত্যবর্জ্যও আছে।মিডিয়া মালিকের পোষ্য থেকে সাইবার মহল্লার তোষ্য দল পাকায়ে ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসের অপব্যাবহার করে বইমেলা থেকে রানা প্লাজাতে মনন ও প্রানের ধ্বশ নামাতে পারে।হুমকি প্রেমিসের এই বাস্তবতাগুলো নেবার পরেও শেষ অব্দি ভাষার দৈনন্দিন ব্যাবহারে আমি ইউজার ফ্রেন্ডলিনেসের দিকে।আমার হাতিয়ার অভ্র ইউনিকোড।বাংলা ব্লগার রেনেসা ঘটেছে অভ্র ইউনিকোডকে বাহন করে।আর পারিবারিক গন্ডিতে আমার ছেলেমেয়েদের মা দুজন ইংরেজ ও ফরাশি বংশদ্ভুতো, ওদের কমন ভাষা নিজেদের ভেতর ও আমার সাথে ইংরেজি।ফ্রান্সে জাত্যাভিমান পার হয়ে ১৪ বছরের প্রথম জাতিয় পরিক্ষার ভাষা মাধ্যম হিশেবে ইংরেজির দিকে সমান, কখনো বেশি হারে বিনিয়োগ হচ্ছে।ইয়ুজার ফ্রেন্ডলিনেসের একটা ব্যাপার হচ্ছে নেয়া।নেয়া বাড়ালে, দেয়াটা অবস্যই বাড়ানো যায়।
 
ভাল থাকবেন।
 
 
চয়ন খায়রুল হাবিব
৮/০২/১৮
ব্রিটানি