Thursday 11 May 2017

ধর্ষনবান্ধব রাষ্ট্রে শবেবরাত


শেষ কবে একটা কবিতার বই কিনেছেন আপনারা বলতে পারছেন না।শেষ কোন বইটি পড়েছেন, তা যারা কবি, গল্পকার, শিল্পি দাবি করছেন তাদের স্টেটাসেও জানা যাচ্ছে না।পাঠ্য বই, ভয় দেখানো ধর্মের বইয়ের বাইরে শিশুর হাতে নিয়মিত শিশু সাহিত্যও তুলে দিয়েছেন কি, বোঝা যাচ্ছে না, তাহলেতো অন্যদের খোজ দিতেন।

প্রমিত বা অপ্রমিতে যারা নিজের সাহিত্য চর্চা নিয়ে বলছেন, তাও পড়ে পাওয়া খবরের প্রতিক্রিয়া, কিন্তু তার আগের মননজাত শৈলির কোন ছাপ তাতে নাই।যে ছড়াগুলো নিয়ে মাতামাতি তাও পড়ে পাওয়া খবরের প্রতিক্রিয়া।আপনাদের ভেতর ধর্মচর্চা কিন্তু বেড়েছে, সাথে কদাচারও।সাহিত্যচার্চাকারিরা, শিল্প অফিসারেরা, কথিত শিল্পিরা, কথিত এক্টিভিষ্টরা যেসব বইপত্র কেনে তাও কোন বস বা দাদাকে সন্তুষ্ট করতে।চারুকলা ইন্সটিউটে যে ছেলেমেয়েরা ৩০ বছর আগে আঞ্চলিকতার অনুশিলন করেছে, তাদের আজকের সাইবার আচরনে আঞ্চলিকতাকেই পরিনত চারুকলা বলে প্রতিভাত হচ্ছে, যার সাথে যোগ হয়েছে চাপানো ধর্মবোধ।জ্যেষ্ঠ কবি বলে পরিচিত কিছু বয়োবৃদ্ধ স্বার্থগৃধুর সাথে মিলে জাতিয় কবিতা পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদেরই এক বন্ধুরত্ন, যেখানে আমাদের প্রজন্মের কোন কবি আমন্ত্রন পায় না এবং যা পুরোপুরি ছড়কারদের দখলে।অপরদিকে আল মাহমুদের সমঝদার পাঠকদের প্রিয় চরনগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে নারিকে রতিযন্ত্র ছাড়া আর কোন বিবেচনা দেয়া হয় নাই।চারুকলা ও কবিতামঞ্চের এহেনো অবস্থা মানে ধমনি ও হৃদপিন্ডে বড়ধরনের গড়বড় হয়েছে।

শিল্পকলাতে লাখেরাজ করে বস্তাপচা যেসব নাটক মঞ্চায়ন হয় তাতেও মাফিয়া কারসাজিতে মেধাবিদের হটিয়ে দেয়া হয়।রবীন্দ্রচর্চাকারিরা রবীন্দ্রনাথের নিহিত শিক্ষা ভুলে পুরো ব্যাপারটাকে বানিয়েছে জাতে ওঠার এবং অন্যকে অবজ্ঞা করবার জ্ঞানপাপে।আরেকটা ব্যাপক কুপমন্ডুকের দল হচ্ছে আবৃতি সমন্বয় পরিষদ, যারা আবৃতি উপযোগি কবিতার নামে গত সিকি শতাব্দি মননের চর্চাকে নিয়ে গেছে মননের গুমখুনের অনুশিলনে।বাংলা একাডেমিতে গিজগিজ করছে মননের গুমখুনকারিরা।মিডিয়া থেকে মনন আসবে না। তাহলে সুলতান সুলেমানের ধাক্কায় কাত হওয়া চ্যানেল শিল্পিরা শহিদ মিনারে এসে মাতম করতো না।কিছুদিন আগে প্রজন্ম ৭১ এর সংগঠকেরা তাঁদের গল্পপাঠ অনুষ্ঠানে হাতে গোনা দর্শক নিয়ে আক্ষেপ করেছে।বিভিন্ন মঞ্চের দখলদারিতে ঘুরেফিরে একই লোকজন দেখতে, দেখতে লোকজন আস্থা হারিয়েছে এমন কি সত্যিকার গল্পগুলোতে।আর আপনি মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ, আর ধর্ম দেখিয়ে ঘুরেফিরে নিজের পরিবারের কথা বলতে থাকলে তার শোভনতাও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে ওঠে।

মনন তৈরি হয় সাহিত্যের পাঠ থেকে।খেয়াল করে দেখুন সাহিত্যের সাথে, শিল্পের সাথে জড়িত সংগঠন ও ব্যাক্তিরা তাদের স্বার্থের সাথে ডান, বাম রঙ মিশিয়ে যেসব তত্ত্ব হাজির করছে তাতে আমাদের দৃড় বিশ্বাস জন্মাবে যে এই দেশের খালে, বিলে কচুরিপানাও ছড়িয়ে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদিরা।মননের মঞ্চ সঙ্কোচনের ফলে ধর্ষণের মঞ্চের বিস্তার ঘটছে।কি ইস্যুতে আপনি চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন, তার তলানিতে তাকালে আপনি বুঝবেন যে ধর্ষিতার প্রতি, বিচারের দাবির চেয়েও আপনার ভেতরে অন্য কোন অবদমনের সুড়সুড়ি কাজ করছে।

মননের মঞ্চগুলোতে মননকে ধর্ষণের, মননকে গুমখুনের যে প্রাতিষ্ঠানিক যজ্ঞ পত্র, পুষ্পে মঞ্জরিত, তা থেকেই ধর্শনবান্ধব রাস্ট্রের বিকাশ।এখানে রাস্ট্র বিমুর্ত, নৈর্ব্যাক্তিক।যারা রাস্ট্রকে বদলে ব্যাক্তির দায় গৌন করতে চায়, তারা মননের চর্চাকেও এক রৈখিক শর্তে ফেলে দিতে চায়।তাদের মত না বললে, না চললে তারা আপনাকে নেবে না।রাস্ট্র নিয়ে মাতামাতি করনেওয়ালারা যে তকমাতেই আসুক, তাদের ক্ষ্মতায়নের পথে বেশুমার মননের হত্যাযজ্ঞ।এই হত্যাযজ্ঞে বিশেষজ্ঞরা এখন ঐতিহাসিক ভাবে এতটা সিদ্ধিলাভ করেছে যে গিরগিটির মত রঙ বদলে ঢুকে যাচ্ছে যে কোন মননের মঞ্চে, আঞ্চলিকতার অজুহাতে, সংস্কৃতির অজুহাতে, ধর্মের অজুহাতে, রাজনিতির অজুহাতে, আর তাদের সহায় হচ্ছে মিডিয়া।

বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন নবায়ন করে সম্প্রতি যখন মেয়েদের আইনি বিয়ের বয়স ১৬তে নামানো হলো, তখন কিন্তু এই মিডিয়া, এই সাংস্কৃতিক মঞ্চগুলো সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলে নাই!একই ভাবে শিশু শিক্ষার কারিকুলামে হেফাজতি দাবিতে হিন্দুত্বের অভিযোগে ব্যাপক রদবদলেও সাংস্কৃতিক মঞ্চগুলো নিরব থাকে।এই রদবদলগুলো নৈর্ব্যাক্তিক রাস্ট্রের হয়ে ব্যাক্তি করেছে, যে পদবি টিকিয়ে রাখতে নিরব থেকেছে সেও ব্যাক্তি!

ধর্শনবান্ধব রাস্ট্রের লাঠিয়াল হচ্ছে পুলিশ এবং তার মুখপত্র হচ্ছে মিডিয়া।অপরাধ সঙ্কোচনে যে ব্যাক্তিত্বের উন্মেষ, মননের বিকাশ ভুমিকা রাখে তার  সাথে এই মিডিয়া ও পুলিশের বিরোধ।আবার এই মিডিয়ার পেছনে যে বিপনন সংস্থাগুলো ছড়ি ঘোরাচ্ছে তারাও ব্যাক্তির মননকে দেখছে হুমকি হিশেবে।এহেনো পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সচেতন মেধাবি গরিব তরুন বা তরুনির সাথে বিবাহ বন্ধনে আসছে কিছু বড়লোক রাজনিতিক বা মিডিয়া/বিপনন পরিবার।এই বিবাহ বন্ধনের পর ঐ কথিত সচেতন তরুন বা তরুনি নামছে মননের গুমখুনে, নিরবতার দেয়াল তুলে ব্যাক্তিত্বকে একঘরে করবার কারসাজিতে, কিন্তু ভান করছে মননের, আর পারিবারিক বিপনন সংস্থা সেই ভান, ভনিতাকে চটকদার মোড়কে ভরে বাজারজাত করছে।মুশকিল হচ্ছে বাজারও সেই টেলিভিশান ফ্রেম নোংরা করা, কান পচানো বাজে উচ্চারবের মোড়কগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে।আমরা এখন প্রশ্ন তুলতেই পারি 'রেডিও স্বাধিন' কতটুকু স্বাধিন, 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট' পত্রিকা  কতটুকু ইনডিপেন্ডেন্ট, 'মুক্তমনা ব্লগ' কতটুকু মুক্তমনা?

এসব চক্রের বাইরে ব্যাক্তির মনন, দৃষ্টিভঙ্গি, নবায়িত অধিকারবোধ, সুক্ষ চিন্তা, সহজ নান্দনিকতা ধরে রাখছে আবহমান সাহিত্য।আবহমান হচ্ছে একটা পরম্পরা, যা ধ্রুপদকে ধারন ও লালন করে সমকালকে নবায়ন করে।আমাদের মিডিয়ার সে ক্ষ্মতা কখনো আসবে না, কারন এর নেতৃত্ব আত্মঘাতিভাবে গোষ্ঠিস্বার্থ নির্ভর, সাংস্কৃতিকভাবে সামন্তবাদি।বিনোদন এবং মননের মঞ্চকে আমরা যত সাহিত্যমুখি করবো, তত এই সামন্তিয় জগদ্দল থেকে বেরোবার পথ প্রশস্ত হবে।


চয়ন খায়রুল হাবিব
১২/০৫/১৭
ঢাকা