Thursday 6 February 2014

ভাষাচিন্তাঃ ব্যাক্তিত্ব শব্দটা নিয়ে বিভ্রান্তি

ব্যাক্তিত্ব শব্দটা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগার আগে বাংলা ভাষার প্রায়োগিক দিক থেকে ব্যাক্তিত্ব বলতে চাপাবাজ এবং সাদা মিথ্যায় ওস্তাদ বুঝতাম!তারপর লোকজন ক্রিড়াবিদ না বলে ক্রিড়া-ব্যাক্তিত্ব; শিক্ষাবিদ না বলে শিক্ষা-ব্যাক্তিত্ব; নাট্যকার বা অভিনেত্রি-অভিনেতা না বলে নাট্য-ব্যাক্তিত্ব বলা শুরু করলো !মিডিয়া এখানে আরেক কাঠি ওপরে, ওখানে সবাই হয় মিডিয়া-এক্টিভিস্ট নয় মিডিয়া-ব্যাক্তিত্ব এবং সেরের ওপর সোয়াসেরিদের ওখানে বলা হয় টক-শো-ব্যাক্তিত্ব!সে হিশাবে অবস্য ব্যাক্তিত্ব বলতে আমার আগের চাপাবাজ বুঝটা তেমন ভুল না!

তাহলে আমার বিভ্রান্তিটা কোথায়?ধরুন কাকে ক্রিড়া-ব্যাক্তিত্ব বলা হবে?ক্রিড়াবিদ যখন অবসর গ্রহন করবে তখন?কিন্তু ক্রিড়া-সাংবাদিক, ক্রিড়া-ভাস্যকারদেরওতো ক্রিড়া-ব্যাক্তিত্ব বলা শুরু হয়েছে!সে হিশাবে আমরা পাব সেনা-ব্যাক্ত্বিত্ব, শিক্ষা-ব্যাক্তিত্ব, চিড়িয়াখানা-ব্যাক্তিত্ব!রাজনিতিতে সক্রিয় থাকলে কি বলা হবে রাজনিতিবিদ, আর অবসর নিলে বলা হবে রাজনৈতিক-ব্যাক্তিত্ব?তাহলে টাউটারির সাথে বাংলা-ব্যাক্তিত্বের একটা ব্যুতপত্তিগত মিল আছে!একটা প্রতিষ্ঠান যত তলাতে থাকে বাংলাদেশে সে-প্রতিষ্ঠানে তত ব্যাক্তিত্ব বাড়তে থাকে!

চিত্রশিল্পি সুলতানকে কি চিত্র-ব্যাক্তিত্ব না কি শিল্প-ব্যাক্তিত্ব বলা হবে?তাহলে শিল্পপতিদের কি বলা হবে?না কি সুলতান যেহেতু নিয়মিত গাঞ্জা সেবন করতো, সেমতে তাকে শিল্পি-সুলতান না বলে গাঞ্জা-ব্যাক্তিত্ব ডাকা হবে?
 
বিভ্রান্তির গোড়াতে দেখলাম বাংলাদেশের হিতৈশি একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি/নব্বইতে প্রতিষ্ঠিত এন্থ্রপলজিকাল বিভাগগুলো!ব্রিটিশ ভ্রদ্রলোকের নাম সায়মন ড্রিঙ্কস, অবজারভারের এই সাংবাদিক ১৯৭১এ বাংলাদেশের পক্ষ্যে দুর্দান্ত সব নিবন্ধ লিখেছিল!নয়াগঠিত বেসরকারি চ্যানেলগুলার কোন কোনটা নব্বই সালে  সায়মনকে একই সাথে সহযোগি এবং প্রশিক্ষক হিশাবে নিয়ে আসে!প্রেসক্লাবের পচাগুলাকে এড়াতে না কি হারেম বানানোর খায়েশে বুড়া সায়মন তরুন-তাজা ছেলেমেয়েদের চাইলে ঘটনাচক্রে জাহাঙ্গিরনগরের এন্থ্রপলজি বিভাগের প্রচুর ছাত্রছাত্রির একটা যোগান সে পেয়ে যায়!

সায়মন যেভাবেই চাক তার তোয়াক্কা না করে চ্যানেল মালিকেরা তাদের বার্তা বিভাগে উচু পদে বসায় সরকারি রেডিও, টিভির সাবেক কর্মকর্তাদের এবং তার সাথে প্রেসক্লাবের কিছু পচাদের!প্রেসক্লাবের পচাগুলা, যারা দুই-স্লিপ থেকে মিডিয়াতে এসেছে তারা মিডিয়া-জার্নালিস্ট আখ্যায় কোন অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল বলে জানা নাই!আগের রেডিয়, টিভির গুলাও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট আখ্যাতেই বেশ সন্তুষ্ট!এখন প্রেসক্লাবি-পচারা আর সাবেক রেডিও টিভির দুদেগুলা জাহাঙ্গির-নগরের নবাগতদের বলা শুরু করলো 'ট্রেইনি...' কখনো বা নিছক 'ছাত্র...'!এই ট্রেইনি এবং ছাত্র শব্দ এড়াতেই না কি তারা নিজেদের প্রথমে বলা শুরু করলো এন্থ্রপ্লজিকাল-একটভিস্ট, তারপর মিডিয়া-এক্টিভিস্ট এবং পচাপার্টির যাদের সাথে জমে গেলে তাদের বলা শুরু করলো মিডিয়া-ব্যাক্তিত্ব!মানে ঐ চাপাবাজের মতই একটা পরিচয় লুকাতে পানি ঘোলা করা আর কি!

এইটুকু অব্দি আসলে আপনার ধৈর্জের সম্মানে এবার কথা সঙ্খেপে সারি!এই যে যাদের হেনতেন ব্যাক্ত্বিত্ব বলা হয় তারা বাংলাদেশের জন্য কয়টা ফুটা পয়সা আয় করে?গার্মেন্টস, ট্যানারি আর প্রবাসি শ্রমিকের আয় খরচ করে এরা কথিত ব্যাক্তিত্ব!এই চাপাবাজ, সাদা মিথ্যার লোকজনকে এই সেই ব্যাক্তিত্বের সম্মাননা না দিয়ে বরং গার্মেন্টস শ্রমিককে গার্মেন্টস-ব্যাক্তিত্ব; সেমত ট্যানারি-ব্যাক্তিত্ব...কিন্তু এই মেকাপ-কস্মেটিক্সের চেয়ে দৈনন্দিন সংগ্রামটা এদের জরুরি!

পরিচয়-লুকানেওয়ালা-ব্যাক্তিত্ববাজেরা অন্যসব পরিচয়েও একটা গোলমাল পাকাতে চাইছে!তারা অন্ধ, কানা এসব শব্দ বাদ দিয়ে বলতে চাচ্ছে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধি, বোবাকে বলতে চাচ্ছে শব্দ-প্রতিবন্ধি!তার ওপর বাংলাদেশি বাবা মায়েদের ছেলেমেয়েদের খটোমটো নাম দেবার যে দৌড়াদৌড়ি, সেখান থেকে হয়ত শুরু হবে বলা যে 'দেখেন আমার বাচ্চা-ব্যাক্তিত্বটা কি ভাল টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল পড়ছে!'

বিভিন্ন সেক্টরে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাক্তিত্ববাচক সম্মাননা দেয়ার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য জাতিয়-ব্যাক্তিত্বদের একটা কমিটি গঠন করা যেতে পারে!এই কমিটির কাজ হবে অত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগসহ অপরাপর বিভাগে বাংলা  প্রায়োগিক শব্দ, প্রতিশব্দের ভান্ডার বাড়ানো!সে-অব্দি ব্যাক্তিত্ব শব্দটা চাপাবাজ আর অবসরপ্রাপ্ত অর্থে রাখাটাই সমিচিন!ক্রিড়া-চাপাবাজ, শিক্ষা-চাপাবাজ, নাট্য-চাপাবাজ, মিডিয়া-চাপাবাজ, টক শো-চাপাবাজ এবং ক্রমশ...চাপাবাজদের বলা হবে চাপা-ব্যাক্তিত্ব!

চয়ন খায়রুল হাবিব
৬/০২/১৪
ব্রিটানি-ফ্রান্স

সুলতানের ছবিঃ নাসির আলি মামুন