Sunday 10 January 2010

আজিম্পুরের স্বর্নদুয়ারেঃ আশির স্নাইপারেরা ২

বাড়িটা এখনো টিকে আছে।২০১০।

আমার জন্ম থেকে বড় হওয়া ষাটের, সত্তরের ঢাকার আজিম্পুরে এক ভাড়াবাড়িতে।১০৭/এ পিলখানা রোড!কবরস্থানের ঠিক উলটো পাশে; রক্তজবা আর রডোডেন্ড্রনের ঝাড় ঘেরা সাদা চুনকামের সেই বাংলো বাড়ির সামনের গোল বারান্দা ঘেরা রডোডেন্ড্রনের ঝাড় না থাকলেও আব্বার হাতে লাগানো অনেক গাছ এখনো ওখানে আছে!

পিলখানা থেকে শহিদ মিনার অব্দি যা যা ঘটন, অঘটন তার তরতাজা খবর বাসায় পৌছে যেত মুক্তি্যুধ্বের আগে ঢা,বি'তে পড়ুয়া চাচাত ভাইদের সুত্রে; মুক্তিযুধ্বের পর বোনদের সুত্রে।আর আশির দশকে নিজেই হয়ে উঠি চলমান বার্তাগুলোর ধারক, বাহক, দর্শক এবং একজন কিম্ভুত সুত্রধর।

আজিম্পুরের বাসার বর্তমান নিবাসি লায়লা'পা'র সাথে আমার স্ত্রি প্যাট্রিসিয়া, ছেলে মাতিস।২০১০।

বাবা'মা' ভাই বোনদের পিছু পিছু ছেলেবেলায় আমার ঘোরাঘোরির সার্কিট ছিল ১২২ আজিম্পুর রোডের ডঃ ফজলুল হকের দোতালা বাড়ি থেকে, সলিমুল্লাহ মুস্লিম এতিমখানার সামনে ওয়াসার বাংলো বাড়িটা।ঐ বাড়িতে থাকতেন দেলোয়ার হোসেন; আমাদের দেলু কাকা।ফজলুল হক আমার বড় মামা।দায়রা শরিফের শরিক না হওয়া সত্বেও বড় মামা'কে দায়রা কল্যান সমিতির প্রথম সভাপতি করা হয়েছিল। ওনার বাড়ি ছিল দ্বিতিয় বিশ্বযুধ্বের পর দায়রা শরিকদের বাইরে আজিম্পুরের প্রথম প্রাইভেট বাড়িগুলোর একটি।একই রোডে বাড়ি তুলেছিল শহিদ আবুল কালাম আজাদ; আজিম্পুর স্কুলের প্রথম দিককার প্রধান শিক্ষক আম্বর আলি, যার খ্যাতিমান বুদ্ধিজিবি-আমলা জ্যাষ্ঠ সন্তান মনজুরে মওলার  নিবাসও একই ঠিকানাতে!



আজিম্পুরের আরেক বনেদি বাড়ি ছিল আবু সাদাত সায়েমের বাড়ি।ও ব্যটা কারো সাথে মিশতনা।কেউ ওর মেনি কিউর করা লন নিয়েও মাথা ঘামাতনা।ঐ বাড়ির সুত্রেই সত্তরের শেষ দিকে পাড়াতে পুলিশি টহল বেড়ে যায়।সায়েমের বাড়ির পাহারাদার এক পুলিশ'কে আমরা ডাকতাম পাগলা বলে। নামের মর্জাদা রাখতেই পাগলা কবরস্থানের ভিখারিনিদের সমবায় সমিতি হিশাবে কাছাকাছি এক বাড়িতে পতিতালয়ের পত্তনি ঘটায়।


দাড়িওয়ালা দোকানি আলি এবং মাঝখানে ওনার ছেলে মাওলার সাথে মাতিস আর আমি।২০১০।মাতিসের চেয়েও ছোট বয়সে আমি বাসার সামনে আলির দোকানে যেতাম মধু সন্দেশ কিনতে!
আম্মার পেছন, পেছন বড় মামা'র বাড়ি যাবার সময় আলির দোকান, লতিফের দোকানের কর্মচারিদের সম্ভ্রমপুর্ন আচরনের সাথে লজেন্স পাবার কথা বেশ মনে আছে।আম্মা ঐ দোকানগুলোতে থেমে সিগারেট কিনত, আর ভাইয়ের বাসাতে গিয়ে সেগুলো পোড়াত।বড়মামা'র জন্য আম্মা ছিল নুইসেন্স।আমাদের জন্মের প্রথম বছরে প্রিয়তমো ছোট ভাইকে হারিয়ে শোকে আম্মা'র স্থায়ি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়।ক্রনিক ডিপ্রেশান ছিল আগে থেকেই।সেই ভাই'ই আম্মাকে সিগারেটের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল।ভাইকে কবরও দেয়া হয়েছিল আমাদের বাসার সামনে আজিম্পুর পুরানা গোরস্থানে।সিগারেট ছাড়া আম্মার নৈমিত্তিকতা চলত ইনোকটিন জাতিয় ট্রাঙ্কুয়ালাইজারে, বড় ভাইয়ের বাসাতে দুপুর থেকে সন্ধ্যা, আর কবিতা লিখে।আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করবার পর আম্মা কবিতা লেখা থামিয়ে দেয়।তার পর শুধু ঘুম আর ঘুম।


আজিম্পুর পুরান গোরস্থান।২০১০।

বড়মামাকে লোকে ডাকত ডঃ হক।জিবনের প্রথম ভাগে কিছুদিন ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢা, বি'র মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করে উনি ওয়াপদাতে পরামর্শক হিশেবে যোগ দিয়ে, কমিশনার হয়ে অবসর নেন।বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর সুত্রে বহু পুরোনো ছাত্র ওনার বাসায় আসত।আর বড়মামার ছিল ঘড়ি ধরে নিলখেতের ক্লাবে যাবার নেশা।বড়মামা'র ছেলে ক্যডেট কলেজ থেকে স্টার মার্ক পাবার পরও বহিস্কৃত, নটরডেমের বাবু ভাই' ফায়জুল হকে'রর সুত্রে ঐ বাসায় নিওমিত হাজিরা দিত 'উন্মাদ' সম্পাদক ইশ্তেয়াক।বাবু ভাই'র আরেক আড্ডা ছিল আজিম্পুর রোডের ওপর কোলকাতা থেকে আসা বজুর বাপের বাড়ি।ওখানে আরো আসত পাসাপাসি থাকা কাদেরি কিবিরিয়া বা লোথা ভাই।ওটা ছিল ভদ্রস্থ গাজার ডেন।আর আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় রুবেনের গিটার বাজানো'র সুত্রে বড়মামার বাড়িতে প্রায়ই দেখা যেত হ্যাপিকে।


আজিম্পুর দায়রা শরিফের প্রবেশ-দুয়ারে চয়নের স্ত্রি প্যাট্রিসিয়া ও ছেলে মাতিস।২০১০।

হ্যাপিকে দেলু কাকা'র বাসাতেও দেখা যেত।ঐ বাসাটা ছিল বা'ফা' বা বুলবুল ললিতকলার র ছেলে, মেয়েদের আড্ডা।কাকা ডাকলেও দেলু কাকা আমাদের আপন কাকা ছিলেন না।ওনার বাবা ছিলেন আমার দাদা কুমিল্লার চিওড়ার সুফি খলিফা জমির শাহ'র মুরিদান।আব্বার ওসবের বালাই ছিলনা।নিজেদের নামের সৈয়দ, শা' সবই আব্বা চাঙ্গে উঠিয়েছিল।তবে মহাস্থান গড়ের সুলতান শাহ'র খান্দান এবং জমির শাহ'র ছেলে হিশেবে আব্বা দায়রা শরিফে সম্মান পেতেন।

দেলু কাকা'র ৩ মেয়ে শেলি, নেলি, ডলি আর একমাত্র ছেলে 'ওরা এগারোজ়ন' খ্যাত বাবু (আমির হোসেন) ছিল ষাটের সত্তরের ঢাকা'র সংস্কৃতি'র ডার্লিং।এই নাচের লোক, ঐ গানের লোকে বাড়িটা সবসময় জমজমাট।খান সরোয়ার মুরশেদ আসছে মেয়েকে নিয়ে যেতে, অঞ্জনা রহমান লিফট চাইছে এর তার কাছে।কটা চোখো তামাটে চামড়া'র, খড়গ নাসা দেলু কাকা'র সাথে গোলাপি চামড়া'র বোচা নাকের বর্মি স্ত্রির মিশেলে শেলি, নেলি, ডলি, বাবু'র চেহারা ছিল রুপকথার রাজকুমারি, রাজকুমারের মত।সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করবার সময় পুরোপুরি এল্কোহলিকে পরিনত বাবু ভাই পরিনত ওনার নিজের ফসিলে।আমাদের বাসায় দেলু কাকাদের দাওয়াত থাকলে ৭১'এর পর বাবু ভাইকে তেমন পাওয়া যেতনা।আর যখন হাজির হতেন তখন সাথে এফ, ডি, সি'র কোন না কোন সাংগপাংগ।বইমেলা বা বৈশাখি মেলা থেকে আব্বার হাত ধরে ক্যম্পাস ধরে শর্টকাট মারবার সময় টী, এস, সি'র সামনে দেখতাম ডলি আপা চিনাবাদাম চিবাচ্ছে সুবর্না, রাইসুল আসাদ'দের সাথে।আব্বাকে ওনারা বলত জ়েইয়া।আর আমাদের দুই জমজ ভাই বোন'কে চয়াকঙ্কা!




আজিম্পুর কবরস্থানের পাশের খাদ্য মন্ত্রনালয়ের প্রধান যানবাহন দফতর আর না থকলেও, তার উল্টোপাশের এ-পুরানো বাড়িটার কাঠামো এখনো(২০১০) বদলায় নাই!আমাদের বাসাসহ, পেছনের আরো কটা বাড়ি এবং পাশের এই দোতালা বাড়িটাকে একসাথে বলা হতো দায়েম ম্যানশান।মালিক দায়রা শরিফ আর স্থপতি ছিলেন সে বাড়ির মুরিদান হাজি সাহেব।ছবিতে যে গাড়িবারান্দা তাতেই আমি ১৯৭১এর ২৬শে মার্চ প্রথম মুক্তিযুদ্ধ্বের মৃতলাশ দেখি।তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পাঠরত কাঞ্চন ভাই ওনার প্রভোস্ট মামার সাথে(হলের নাম মনে নাই) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ২৫শে মার্চ রাতে।ঐ মামার পরিবার সে রাতে ওখানে ছিলনা!২৬শে মার্চ সকালে আঞ্জুমানে মফিদুলের এম্বুল্যান্স কাঞ্চন ভাই আর ওনার প্রভোস্ট মামার মৃতদেহ এই গাড়িবারান্দাতে পৌছে দিলে এক গগনবিদারি দৃশ্যের অবতারনা হয়!এ-ভবনটার পাশেই প্রেসিডেন্ট সায়েম পাকিস্তান আমলে বানানো এক তলা এক বাড়িতে বসবাস করতেন।

২৬শে মার্চ আমাদের পাড়ায় যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম্বুল্যন্সে করে কাঞ্চন ভাই আর ওনার প্রভোস্ট বড় মামা'র লাশ পৌছে দেয়া হয়; তখনই আমার বড় মামা, আব্বা এবং আজিম্পুরের অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার সিধ্বান্ত নেয়।দেলু কাকাদের পরিবারও আমাদের সাথে যোগ দেয়।প্রথমে সবাই আমাদের নানাবাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।কিন্তু ওখান থেকে খবর আসে যে ময়নামতি আর চিটাগাংযের পাকিস্তানি রেজিমেন্টগুলো তাদের অগ্রবর্তি শিবির গেড়েছে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড জুড়ে।আর নানার বাড়ি পাকা হওয়ায় ওখানে ক্যাম্প বসানো হয়েছে।কিশোর কয়েকজন মামাসহ নানা সিমান্ত পার হয়ে ভারতের শরনার্থি শিবিরে পালিয়ে যান।আম্মার খালাত বোনের জামাই বরিশালের বি'ডি হাবিবুল্লার' বাড়িতে যাবার কথাও উঠেছিল।শেষ পর্জন্ত বড় মামা খোজ করে কলাতিয়া, ভাড়ালিয়া ও মাতুয়াইলের আত্মিয় বাড়িগুলোতে দু'ভাগে পরিবারগুলোকে পাঠানোর সিধান্ত নিলে, দেলু কাকাদের বাবু ভাই আর ওনার বন্ধুরা প্রায় দশ, বারটা পরিবারকে এসকর্টের দায়িত্ব নেয়।

সদরঘাট থেকে অল্প দুরে ওয়াসার এক নদি তিরস্থ অফিসের লাগোয়া ঘাটে সবগুলো পরিবার'কে নৌকাতে উঠিয়ে দিয়ে বাবু ভাই বন্ধুদের সাথে পেছনে থেকে যায়।ছোটদের ভেতর আমরা ফিশফিশিয়ে বলতে থাকিঃ বাবু ভাই ফাইট করবে।নদিতে ভাসমান লাশ দেখে আমাদের শিশু মন যাতে বেশি ভারি না হয় তার দিকে খেয়াল রেখে একজন রসিক জ্যাষ্ঠ আমাদের হাতে বড় বড় বেলুন তুলে দেন।এখন বুঝি যে ওগুলো ছিল কন্ডম।

নদি পার হবার পর কখনো আব্বার কাধে চড়ে, কখনো এর তার কোলে, বেশির ভাগ সময় মাইলের পর মাইল হেটে আমরা প্রথমে হাজির হই ভাড়ালিয়া'র এক বাড়িতে।তারপর ১৬ ডিসেম্বার পর্জন্ত তিন দফায় ভাড়ালিয়া থেকে মাতুয়াইল, সেখান থেকে শ্রিনগর।আর এই দফায় দফায় উদবাস্তু জিবনে আব্বা দ্বিতিয় বিশ্বযুধ্বের সময়কার সাবেক বিমান সেনানি'র অভিজ্ঞ্বতা থেকে স্থানিয় তরুনদের যথাসাধ্য সামরিক প্রশিক্ষন দিতে থাকে।

আরো পেছনে থেকে যায় চাচাতো ভাই মাকসুদ ও কাদের।মাকসুদ ভাই চাদপুরে রাজাকারদের হাতে, আর কাদের ভাই নিহত হন মিরপুরে বিহারিদের হাতে। দেলু কাকাকেও পেছনে থেকে যেতে হয়।সে আরেক গল্পের ভেতর গল্পঃ

আমার সবচেয়ে বড় বোনের নাম ছবি।কোন এক অজানা কারনে অন্য বড় বোনদের দিদি, এমনকি আপা না বল্লেও, ছবি'কে আমি আর আমার জমজ বোন কঙ্কন দিদি বলে ডাকতাম।এখনও তাই।১৯৭১এ আমাদের বয়স ৬ হলে দিদির বয়স ছিল ২৪।দিদি বিশ্ববিদ্যালোয়ের প্রথম থেকেই স্থাপত্যকলায় পড়া দুর সম্পর্কের খালাতো ভাই শাহেদের সাথে প্রেম করতো এবং মনে মনে বাগদত্ত।মুক্তিযুধ্বের বছর দুয়েক আগে স্তাপত্যকলা'র পাঠ চুকিয়ে শাহেদ কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে চলে যায়, আর মুক্তিযুধ্বের ঠিক আগে দিয়ে কমিশন পাবার অল্প পরেই অন্যন্য বাঙ্গালি অফিসার, জওয়ানদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে গৃহবন্দির ভাগ্য বরন করতে বাধ্য হয়।

আমাদের পরিবার, বড়মামাদের পরিবার, দেলুকাকাদের পরিবার যখন ঢাকা ছাড়বার আয়োজ়নে ব্যস্ত, তখন দিদি গো ধরে বসে যে উনি পশ্চিম পাকিস্তানে শাহেদের কাছে চলে যেতে চান।এই গো থেকে কেউ ওনাকে সরাতে পারে নাই।এদিকে পিলখানার ই, পি, আর সদর দফতর থেকে প্রতি রাতে গোলাগুলির শব্দ; আজিম্পুর রোড ধরে বহরের পর বহর সাজোয়া ট্রাকের ঘর ঘর; জানালার কাচে ভেতরের দিকে খবরের কাগজ সাটা, বাইরে কালো কালি, রাতে মোমবাতির আলোতে দেয়ালে ইয়া বড় বড় ছায়া।এর ভেতর দিদির সাথে আব্বার চিল্লাচিল্লি সার।ঠিক হ'লো যে দেলু কাকা দিদি'কে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে শাহেদের সাথে বিয়ে করিয়ে দিয়ে ফিরবেন।ঠিক তখনো বাঙ্গালি সেনা সদস্যদের গৃহবন্দি করা হয় নি।কিভাবে, কিভাবে পাকিস্তানের পিন্ডি ক্যন্টন্মেন্টে গিয়ে বাঙ্গালি অফিসারদের সাথে উনি দেখা করেছিলেন, দিদি আর শাহেদের বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং ঢাকাতে ফিরে এসেছিলেন তা সবার কাছে বিস্ময়।বিয়ের কয়েকদিনের ভেতর পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত সমস্ত বাঙ্গালি সেনাসদস্যকে গৃহবন্দি করে ফেলা হয়।সেই বন্দিদশা থেকে দিদি, শাহেদ ভাই মুক্তি পান ১৯৭৩এ।

মুক্তিযুধ্বের পর পর বড়মামা'কে দায়রা শরিফের খান্দানদের আরো বেশি প্রয়োজন।বড়মামা'দের একই রোডে থাকা ডঃ আবুল কালাম আজ়াদের ১৯৭১এ নিখোজ হবার পেছনে দায়রা শরিফ পরিবারের এক ছেলের জোগোসাজস আদালতে প্রামানিত হলে ছেলেটির মৃত্যুদন্ড হয়।বংগবন্ধু'র সাধারন ক্ষ্মার আওতায় সে ছেলেটি খালাস হয়ে বেরিয়ে আসে।।

মৃত্তিকা বিশারদ হিশেবে বড়মামা'র নাম নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানিদের কালো তালিকায় ছিল।আর পি, আই, এ তে তেজগা বিমান বন্দরের মটোরযান প্রকৌশলের ভার নেবার আগে আব্বা কর্ম জিবন শুরু করেছিল ব্রিটিশ এয়ারফোর্সে। ১৯৭১এর মার্চে এক পাকিস্তানি মেজর আব্বাকে বিমানবন্দর থেকে উঠিয়ে নিয়ে প্রথমে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে কি এক কাজ সেরে আবার তেজগার পাশে এসে ক্যন্টনমেন্ট গেইটে জিপ থেকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।মেজর আব্বাকে বলেঃYour being an ex-airforce man doesn't help you much.I am supposed to take you in.I doubt that you would come back.Go back to your family.And don't come back to your job.এই নাম না জানা পাকিস্তানি মেজরের প্রতি আমি আমার সন্তানদের এবং তাদের সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাই।

বড় মামা'র মেয়ে'র সাথে প্রধানমন্ত্রি মনসুর আলির বড় ছেলে সেলিমের বিয়ে হলে, সঙ্গত কারনেই দায়রার শরিকেরা বড় মামা'কে ওদের কল্যান সমিতির প্রধান নির্বাচিত করে।আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিমান বন্দরে।ধংশস্তুপের শুন্যতা থেকে বাংলাদেশ বিমানের ভারি যানপ্রকৌশল বিভাগকে স্বয়ংসম্পুর্নভাবে গড়বার পাশাপাশি প্রভাত ফেরিতে আব্বা আমাদের ভাষানি, বংগবন্ধু, সুফিয়া কামাল'কে চিনিয়ে দিতে থাকে।রব, জলিলদের প্রভাত ফেরিতে দেখলেই আব্বার চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়াও বেশ মনে পড়ে যায়।

একাত্তরের পর আব্বা নিজের চাকুরি আর বাসা আমৃত্যু না বদলালেও, আমার স্কুল বদলাতে থাকে দফায়, দফায়।শুরু করি আজিম্পুর ল্যডিস ক্লাবের নার্সারিতে কঙ্কনের সাথে।পাড়ার অন্যন্য ছেলেমেয়েরা লেডিস, লেডিস বলে ক্ষেপাত।তার দায় শুধতেই কি কৈশোরে মারকুটে হয়ে পড়েছিলাম?!এর পর অগ্রনি বালিকা বিদ্যালয়ে কয়েক বছর, সেখান থেকে লিটেল এঞ্জেলস স্কুলে, সেখান থেকে আদমজি ক্যন্টনমেন্ট; সব শেষে ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল।এই স্কুলে একসময় খন্ডকালিন শিক্ষকতা করেছে শহিদ সাবের, ৭১ এ যিনি জিবন্ত পুড়ে মারা যান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনি তার চাকুরিরত সংবাদপত্রের দফতর মার্চের এক ভোরবেলা পুড়িয়ে দেবার সময়।শহিদ সাবের কাজ শেষে ঐ দফতরেই ঘুমাতেন।একই স্কুলে পড়েছে 'জীবন আমার বোন' খ্যাত উপন্যাসিক মাহমুদুল হক এবং তসলিমা নাসরিনের প্রথম স্বামি ৭০ দশকের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ।নাইনে না কি টেনে পড়বার সময় রুদ্র স্কুলের আকঞ্জি স্যারের স্ত্রিকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কিম্বদন্তিতে পরিনত হয়েছিল।


ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের সামনে রিক্সাতে প্যাট্রিসিয়া, মাতিস।২০১০।

বিমান বন্দরের যান প্রকৌষল বিভাগ নিয়ে সুস্থির পরিকল্পনা থাকলেও, আমাকে নিয়ে আব্বার তেমন কোন পরিকল্পনা যে ছিলনা তা এই স্কুল বদলের হিড়িকেই বোঝা যায়।দিদি বল্লতঃ আদমজি'তে দিলে ও ডিসিপ্লিন্ড হবে।দাও আদমজিতে।আম্মা বল্ল এক বছর পরেঃ 'এত দুরে যায়, এত ভোর বেলা উঠে!' দাও আবার স্কুল বদলে!বড় ভাই আপন আব্বা'র এলোপাতাড়ি তদারকি'র থেকে বেচেছিল মামা'র বাড়িতে গিয়ে কিভাবে হঠাত করে ক্যডেট কলেজে'র ভর্তি পরিক্ষায় টিকে গিয়ে।পিছন ফিরে তাকালে দেখি যে আমার বাবা, মা'কে অনেক ভারতিয়ের মতই এক জিবনে ৩ বার জাতিয়তা বদলাতে হয়েছে!

ওয়েস্ট এন্ডে স্কুলের বাচ্চাদের সাথে প্যাট্রিসিয়া, মাতিস।২০১০।

আমার স্কুল বদলের সাথে সাথে আজিম্পুরও বদলাতে থাকে।আজিম্পুর কবরস্তানের সামনে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের জাজ্বল্য প্রমান মিলতে থাকে প্রতেকদিন ভিড় করা অস্থি চর্মসার ফকিরদের পানসা পড়া, মাছি বসা চোখে।মুজিব হত্যাকারিরা আজিম্পুরের মধ্যবিত্তদের আস্বস্ত করতেই না কি জানি না কবরস্থানের সামনে ট্যাঙ্ক মোতায়েন করে।সত্তরের শেষ দিকে জান্তা উপড়ে ফেলতে থাকে আজিম্পুর রোডের ওপর সার বেধে দাঁড়ানো শত শত বছরের পুরানো রেন্ট্রি, অশ্বথ্য,বট।মধ্যাবিত্যদের দেখা যায় পানির ট্রাকে লাইন দিতে।বাসার সামনের বাগান খুড়ে বর্ষার পানি সরানোর ব্যর্থ চেস্টাতে নাকাল হতে হতে আব্বা মিলিয়ে যেতে থাকে নিজের ছায়ার আড়ালে।মন্দের ভাল যে আমার স্কুল জিবনের কোন বন্ধু নাই।আর কোন ধারাবাহিক 'ডিসিপ্লিন'ও আমার চরিত্র নষ্ট করতে পারে নাই।



ওস্তাগার আবুলের সাথে মাতিস আমাদের বাসার সামনে, ২০১০।

বাংলাদেশের যে কোন বড় দুর্জোগে বাস্তুহারা লোকজনের একটা বড় ঢল বিভিন্ন সময় আজিম্পুর কবরস্থানের সামনে দেখা যেত, যারা ক্রমশ কামরাঙ্গির চর হয়ে পুরো ঢাকাতে ছড়িয়ে পড়ত!এভাবেই আবুল আজিম্পুরে এসেছিল এবং ধিরে ধিরে স্থানিয়দের যোগালি এবং ওস্তাগার হয়ে ওঠে!
বিকালের ফুটবল, ক্রিকেট খেলবার বাইরে আমার প্রথম বন্ধু সার্কেল গড়ে ওঠে মেট্রিকের সময় আজিম্পুরের বন্ধু কচি(আহমেদ মুজিব) আর তারিক(সুজাতের) কল্যানে।জমজ কঙ্কন মেট্রিক পাস করে চারুকলা ইন্সটিউটে গেলে কচির, তারিকের দেয়া বন্ধুদের সাথে যোগ হয় চারুকলার বন্ধুরা।নিশিন্দাপরির অডানায় ভর আশির স্নাইপারেরা জেগে উঠতে থাকে বয়রার ঘরে, কবরখোদকদের পাশে।চালারে কাদিরা...

চলবে।

চয়ন খায়রুল হাবিব
ব্রিটানি
৯/০১/২০১০