Tuesday 5 January 2010

ইলিয়াসের পাইপ ও কড়া পাওয়ারের চশমা


দেশ ছাড়বার আগে, আশি’র দশকের শেষ ৫ বছর ঢা, বি-তে আমার ব্যক্তিগত নৈরাজ্যিক এবং বাংলাদেশের গড়পড়তা গুমোট অরাজগতার ভেতর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে এক মহাশ্চর্জ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল।

প্রাক কথন
 আমার আলুথালু অবস্থাতে ঢাকা কলেজে ইলিয়াসের সহকর্মিরা চমকে উঠলেও; ওর লেখক শিবিরিও কমরেডরা এড়িয়ে গেলেও; টিকাটুলিতে ওর বাসাতে, কলেজের অফিস ঘরে আমার একটা হুটহাট ঢুকে যাবার অধিকার তৈরি হয়ে গিয়েছিল।বড় ভাই’র এই অনানুষ্ঠানিকতা ছোট ভাই খালিকুজ্জামানের ভেতর একেবারেই অনুপস্থিতঃ

নব্বইতে ওলে সোয়িঙ্কার 'স্ট্রং ব্রিড' নাটকের  আমার অনুবাদ 'রক্তবীজ' বইটার যখন কেন্দ্রিয় যাদুঘরে প্রকাশনা উতসব হয়েছিল, তখন আ, ইলিয়াসের কথামতো সদ্য পশ্চিম ফেরা খালিকুজ্জামানের সাথে দেখা করতে জা,বি’তে গিয়েছিলাম।ঐ অনুবাদটির এবং প্রযোজনাটির অনেকে প্রশংসা করলেও, খালিকুজ্জামান খুবই নেতিবাচক রিভিউ করেছিলেন, যা আ, ইলিয়াসকে বিব্রত করবার পাশাপাশি আমাকে বেশ মুষড়ে দিয়েছিল।কিন্তু এতে আ, ইলিয়াসের সাথে জমাটি আসরে কোন আড় তৈরি হয় নি।ঐ সময়ই আমি ঢাকার পরিবারগুলোর অন্তর্গত নেটওয়ার্কিং প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষ্য করি। ছেলে, মেয়ে, ভাগ্না, ভাগ্নি, নাতি, নাতনি, হায়দার ভ্রাতা লিঃ, খান ব্রাদার্স আরো কত কি!আ, ইলিয়াসের মুল বিব্রতবোধ ছিল এই পরিবারনিষ্ঠটা নিয়ে; তার ওপর ভাইয়ের আপস্টার্ট স্নবারি।

নব্বই থেকে যখন আমি ঢাকা, লন্ডন, বৃন্দাবন আর রাঙ্গামাটির মনোঘর পর্বে কঠিন নিরামিশাষি সময় কাটাচ্ছি, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে গেলেই লন্ডন ফেরবার পথে ইলিয়াসের সাথে দেখা করতাম আর ওর হাতে তুলে দিতাম চাকমা সুহৃদ’দের দেয়া স্যলাইন টিউবে ভরা দোচোয়ানি।আমার অনেক বন্ধুই এই ঘনিষ্ঠ্তাটি তেমন বুঝে উঠতে পারেনি।সে-সময় আমার ঘনিষ্ট  অনেক গল্পকার ইলিয়াসের কাছাকাছি যেতে পারে নি।এই যে ইলিয়াসের সংগ না নেয়ার ভেতরেই লুকানো ছিল এদের কারো কারো ধাপে ধাপে  মান্নান সৈয়দ আবিষ্ঠতা থেকে মান্নান সৈয়দিয় ক্লোনে রুপান্তরিত হওয়া!একবার ক্লোনে রুপান্তরিত হলে তা থেকে বের হওয়া কঠিন।এদের অনেকে ক্লোনগত স্টেরিও-টাইপ এবং বিষয় বৈচিত্রতার অভাব  কাটাতে সরে যায় লোকনির্ভর ভাষার রিগ্রেশানে। ইলিয়াস এবং অন্যান্য অগ্রজদের বাইরে আমাদের নিজস্ব পরিমন্ডল এতটাই চঞ্চল ছিল যে এসব নিয়ে আমাদের পারস্পরিক কোন বিরোধ হয় নাই।পেছনে তাকালে মনে হয়, সংগ নিয়ে আমার সাহিত্য সতির্থরা আরো সচেতন হলে, আজকে চৈনিক, মার্ক্সিস্ট ও জেহাদবাদিদের যে সম্মিলন ঘটেছে অনলাইনে, অফলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাতে সুদুরপ্রসারি ফাটল ধরানো যেত।

জুরাসিক নাগরিকতায়
ইলিয়াস জুরাসিক-মাপের লেখক।ঐ মাপের লেখকদের রেওয়াজি স্মরনের চেয়ে সমমাপের মেধাবিদের হাতে আবিস্কারটা জমে ভাল।ইতিহাসও হ'লো; ফসিলেরও দফারফা হ'লোনা!

একটু বিস্তার ঘটানো যাক।আশির দশকের রাজনৈতিক আবহের আল্টপকা আলোচনাতে না গিয়েও বলা যায় যে কখনো সাহিত্য আন্দোলনের নামে; কখনো স্বৈরাচারের মুন্ডুপাতের নামে শত শত চতুর্থ শ্রেনির লোকজন সে-সময় কয়েক প্রজন্মের আখের গুছিয়ে ফেলে।পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মেরুকরনের উচু, নিচু শিক্ষকেরা জেনারেল জিয়ার বেসরকারিকরনের ফলে যে-কন্সাল্টেন্সির স্বাদ পেতে শুরু করেছিল; তার জের হিশেবেই এরশাদের আমলে যে-কোন মাপের জনপ্রতিনিধি তাদের কাছে হয়ে ওঠে বাড়া ভাতে ছাইয়ের সামিল।

এই কন্সাল্টেন্টরা নগরায়নের দুস্বপ্নকে সুখস্বপ্ন বলে মধ্যবিত্তকে গছিয়ে দিয়েছিল; সেই নগরায়নের মানষিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কোন অবকাঠামো বাংলাদেশের না থাকা স্বত্ত্বেও।গ্রামগুলোকে গুতিয়ে গাতিয়ে নগরে ঢোকানো হয়েছিল; না কি বেধড়ক পিটিয়ে পাটিয়ে নাগরিকদের পাঠানো হয়েছিল আখেরি আজাবে; কোনটা যে ঘটেছিল তাই আর বোঝা যাচ্ছিলোনা!

নাই-নাই-দেশের পাইরেট- পি, এইচ, ডিরাই এই দলে,ঐ দলে গিয়ে আম জনতাকে বুঝিয়েছিল যে তারা 'স্বৈরতন্ত্রে'র বারোটা বাজাতে চাইছে।কিন্তু ঐ পাইরেট-পি, এইচ, ডি'রা এটা স্বিকার করতে চাইল না যে সরকারে, বেসরকারে ওদের অদক্ষতার ফলেই টনে, টনে 'স্বৈরতন্ত্র' নাজেল হয়েছে।আমের বড় টুকরা'টা খাওয়ার লালুচ্চামিকে কখনো শ্রেনি সংগ্রাম, কখনো নান্দনিকতা বলে চালিয়ে দিতে চাইলো এবং সক্ষমও হ'লো।হ্যপি আখন্দের মতো নিরুচ্চারিত বা উচ্চারিত নুর হোসেনের মত অভিমানিরা এক অর্থে এদেরই লোভানির বলি।

বিভ্রান্তিকর ডাবল এজেন্টদের ফাদে পড়ে একদল আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়; আরেক দল পিতৃদত্ত জান হাতে সাভারের লাল মাটিতে আমৃ্ত্যু ইয়া রব, ইয়া জলিল আজান দিতে থাকে; কমিউনিস্ট তৃতিয় পার্টি প্লাস্টিক সার্জারির সুপারিশ সমেত হাজিরা দিতে থাকে মহাজাতকের কাছে।নির্বিরোধ চতুর্থ পার্টিকে আমি আজিম্পুর গোরস্থানে নরমাংশখোর খলিলুল্লার সহি হেফাজতে ছেড়ে দেই এবং বাবা বেইমান'কে চেয়ার করে গঠন করি আন্তর্জাতিক হাতসাফাই মন্ত্রনালয়ঃ

ক্যন্টন্মেন্ট আর ক্যম্পাসের সার্কাস থেকে গা বাচাতেই য্যনো ইলিয়াস গা এলিয়ে দেন 'সংস্কৃতি' তত্ত্বের শুচিবাই তক্তপোষে; হৃত-স্পন্দনের বদলে 'রাজনৈতিক বন্ধুত্ত্ব' হয়ে ওঠে নৈমিত্তিকতার পেস-মেকার।সেটাতেও ইলিয়াস তেমন পটু না।কখনো পচেছেন মিউজিক কলেজের গুমটিতে, কখনো বা বাধ্য হয়েই সামজিকতা করছেন ঢাকা কলেজের কুপমন্ডুক সহকর্মিদের সাথে।একদিন বসে আছি ওর ঘরে।দরজা পেরিয়ে ঢুকলো ওর এক সহকর্মি।কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠি লুবনার মা।বিভাগ, ব্যচএর পালটি মিলিয়ে লুবনার সহপাঠি বুঝে পালিয়ে বাচলেন।ইলিয়াসের যা স্বভাব, আমারই যে-বেশভুশা তাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে এক পাইপেই গাজা সেবন শুরু করে দেই না কি!

অস্থি, মজ্জা, অবয়ব
ইলি্যাসের শক্তিই ওর সিমাবধ্বতাকে ধরিয়ে দিত! শব্দের সুর বা লিরিক ধরতে না পারার ঘাটতি ও পোষাত বর্ননা আর প্রকরনে।হাসান আজিজুলকে 'খোয়াবনামা' নিয়ে ওর লেখা এক চিঠি যা হাসান আজিজুল ওর মৃত্যুর পরে প্রকাশ করেছিল, তাতে এর পরোক্ষ সমর্থন মিলবে।সে চিঠিতে ইলিয়াস উল্লেখ করেছিল যে প্রবাসি কবি ওমর শামস তাকে 'খোয়াবনামা' নামে একটি  দির্ঘ কবিতা পড়তে দিয়েছে, যা থেকে একই আইডিয়ার ভিত্তিতে ও একটি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছে।হাসান আজিজুল ঐ চিঠিটির টিপ্পনিতে উল্লখ করছে, যারা ওমর শামসের কবিতাটি এবং ইলিয়াসের উপন্যাসটি পড়েছে, তারা দেখবে যে ওমরের পেলব কবিতায় যে 'অস্থি, মজ্জা' নেই তা ইলিয়াসের লেখাটিতে আছে।

ওমরের কবিতার ব্যাপারে হাসান আজিজুলের বক্তব্যে আমার দ্বিমত না থাকলেও, ঐ বক্তব্য বলে দেয় হাসান ও ইলিয়াস দুজনেই কোথায় তাদের সাহিত্যিক ইক্ষনে সিমাবদ্ধ ছিলেন।রক্ত, মাংশ, অস্থি, মজ্জার পরেও আমরা পুর্নাংগ সাহিত্য থেকে আরো একটি শর্ত দাবি করি তা হচ্ছে চেহারা বা অবয়ব।ওমরের ঘাটতি ইলিয়াস কিছুটা পুষিয়ে দিলেও সাহিত্যের মাল্টাই জেন্রে কাজে যে চেহারা বা অবয়ব বা সিগ্নেচাঢ় টিউন জরুরি তা হাসান বা ইলিয়াস ধরতে পারে নাই।আর চেহারার ক্ষেত্রে একেক চেহারা একেক রকম হতে পারে তাদের বিচিত্রতা এবং flaw সহ।মহত সাহিত্যের যে কোন শাখায় flaw একটা গুন।'অস্থি, মজ্জা'র সাথে প্রচুর রক্ত, মাংশ সর্বরাহ করেও অনেক সময় এই অবয়ব বা চেহারা অনর্জিত থেকে যেতে পারে।এই সিমাবদ্ধতার উপলব্ধি কি ইলিয়াসকে বিরলপ্রজ করেছিল?

যে অবয়বের কথা বলছি তাতে যৌনায়ন একটা বড় শর্ত।প্রচুর বর্ননার পরেও প্রায়শই অনেকের সাহিত্যের চরিত্র এবং অনুষংগ যৌন আচরনে বিমুর্ত থেকে যেতে পারে।প্রচুর অস্থি, মজ্জা, রক্ত, মাংশের পর যৌনায়নের অনুপস্থিতি সে বিমুর্ততাকে আরো প্রকট করে তুলবে।যৌনায়ন বলতে যৌনতার রগরগে গ্রাফিক্সের কথা বলছি না।শুধুমাত্র যৌনতাকে নির্ভর করেও ব্যাক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক সাহিত্য হতে পারে, আবার নাও পারে।কিন্তু সামাজিক বর্ননা বাস্তবতা নির্ভর হোক বা ফ্যান্টাসি নির্ভর হোক, ব্যাক্তি বা স্তন্যপায়ি তার সামাজিক শর্তের সাথে সাথে যৌন শর্তেও চলিষ্ণূ থাকে।সামাজিক ওঠানামার চাপের সাথে ব্যাক্তির যৌনায়নেও বিপত্তি ও উল্লাস আসে।তার উকিঝুকি, বিকাশ, বিস্ফোরনেই ফুটে ওঠে চরিত্র এবং অনুষঙ্গের অবয়ব।

যৌনায়িত পরিবেশ
 ইতিহাস চরিত্রায়নের, দৃশ্যায়নের অবাস্যকিয় পোষাক, কিন্তু একমাত্র আবশ্যকিয়তা নয়।ইতিহাসের মোড় বাদলের পাশাপাশি স্তন্যপায়ি হিশেবে মানুষের নিউরোলজিকাল, প্যাথলজিকাল বিবর্তনও তার পরিবেশগত চরিত্রায়নকে নিয়ন্ত্রন করে, হাসায়, কাদায়, তাতায়।আর চরিত্রায়নের এই পরিবেশগত অবয়বে যৌনায়ন শুধু আবস্যক নয়, কেন্দ্রিয় নিয়ামক।শধুমাত্র ইতিহাসকে আবহ করে, যৌনায়ন বা লিঙ্গায়নকে এড়িয়ে গেলে , ন্যারেশান বা বয়ানে যতই মহাকাব্যিক শৈলি আনা হোক তা ব্যাক্তিক ভরকেন্দ্র হারিয়ে ফেলে, চেহারা হারিয়ে ফেলার পাশাপাশি।

এখানে শুধু ইলিয়াস, হাসান আজিজুল নয় তাদের কিছু আগের পরের বিভিন্ন জন্রেতে কাজ করা জহির রায়হান, আলমগির কবিরের নাম আসতে পারে।একের পর এক সামরিক শাষনের যাতাকল পেরিয়ে এদেরকে মৌলিক অভিভ্যাক্তির যে স্তরে থাকতে হয়েছে, তাতে সৃজনশিলতার ব্যাক্তিক যৌনায়ন কঠিন বটে।তবে মাক্সিম গোর্কি, তুর্গেনিফের সাথে নাবোকফের পার্থক্য দেখলে, আইরিশ অপরাপর সমসাময়িকদের সাথে জয়েসের তুলনা করলে, রবীন্দ্রনাথ থেকে জগদিশ গুপ্ত,  জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর পর্বান্তর পাঠ করলে,  হাজার বছর আগের গ্রিক লেসবিয়ান কবি শাপ্যের বয়ানগুলো পড়ল্‌ বাতসায়নের কামসুত্রে , আরব্য রজনির মৌল প্রস্তাবনায় প্রবেশ করলে বোঝা যায় ব্যাক্তি তার যৌনায়িত উচাটনে সমাজের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারে।ইলিয়াস, হাসান আজিজুল, জহির রায়হানেরা এ জায়গায় এটিএম সচেতনভাবে রাজনিতি ও ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসায়, পরের কয়েক দশকের অন্যান্য কলাকেন্দ্রগুলোও বিমুর্ততায় আবিষ্ট থেকেছে।

অনেকে যাদুবাস্তবতায় লিখেছে।কেউ কেউ বিশাল ক্যানভাসে, কেউ কেউ অতি ছোট ক্যানভাসে।আমাদের পল্লি সাহিত্যে, রুপকথায়, উপকথায়, জারিগানে, পুথিতে, পট শিল্পে যাদুবাস্তবতার প্রচুর রসদ রয়েছে।কিন্তু যৌনায়নের গুনগত পর্জায়ে আমাদের এমন কি উত্তর আধুনিক পর্বের লেখকেরাও লোকজ বিমুর্ততা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে নাই।আমরা জোরালো কার্টুন পাই, পাকা হাতের বিমুর্ত জলরঙ পাই, ইলাশট্রেশানের মুন্সিয়ানা পাই, ক্যালিগ্রাফি পাই, কিন্তু একক ব্যাক্তি ও তার যৌনায়ন পাই না।সম্পর্ক কেন্দ্র করে, শ্রেনি ও বিত্তায়ন কেন্দ্র করে যে পরিবেশায়ন, তার রসায়ন ব্যাক্তিকে কেন্দ্রাতিত করবার বদলে আরো কেন্দ্রনিবিড় করে তোলে।

পুর্ব নির্ধারিত সমষ্টিক শর্ত
গুনগত জায়গাতে একজন মৌলবাদি কবি আল মাহমুদ এবং একজন সমাজবাদি সাহিত্যিক ইলিয়াস বা হাসান আজিজুলে কোন পার্থক্য থাকে না।যদিও আল মাহমুদে নারি অংগ নিয়ে প্রচুর প্রলুব্ধকর প্রতিক রয়েছে, কিন্তু সেটাকে নারির অর্গলমুক্ত যৌনায়ন না বলে পুরুষ শাষনের আদিরসাত্মক রিগ্রেশান বলাই সঙ্গত।ইলিয়াস তার বয়ানে, উপস্থাপনায় এই আদিরসাত্মক রিগ্রেশান থেকে মুক্ত হলেও, অঙ্গিকারের জায়গাটিকে কেন্দ্রনিবিড় করে ফেলে, তার চরিত্রায়ন পরিবেশগতভাবে অর্গলমুক্ত, বাধভাঙ্গা আচরন করতে পারে না।এখানে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, নির্গুন, আবুল হাসান, হুমায়ুন আহমেদ, সৈয়দ হকও তাদের নৈর্ব্যাক্তিক পরোক্ষতায় ইলিয়াসের সহায়তায় এগিয়ে আসে না।উল্লেখিতরা দৈনন্দিন ডায়রিমত ব্যাক্তির সাথে সামাজিকতার চলমান দন্দের সুখবোধ্য, প্রনোদিত, উচ্ছসিত, যন্ত্রনাদির্ন ওঠানামার পারদাঙ্ক অস্থি, মজ্জা, রক্ত, মাংশসহ পাঠকের অস্তিত্ববাদি ক্ষুধার প্রাথমিক চাহিদা পুরনে সমর্থ হলেও, তা যে ব্যালেন্সড ডায়েট নয়, তা বোঝা যায় প্রতিটা গ্যাজেটের অবতির্ন হবার পাশাপাশি বিচিত্র পাঠ প্রবনতা কমে যাবার হার থেকে।

ফরাসি সমাজে, ব্রিটিশ সমাজে, রাশিয়ান সমাজে, মার্কিন সমাজে, জাপানি সমাজে এটা হয় না অর্থাৎ গ্যাজেট আসার পাশাপাশি লেখকের কাছ থেকে ব্যাক্তির পার্স্পেক্টিভ জানবার আগ্রহ পাঠকের কমে না, পাঠ প্রবনতা বার বার নবায়নের প্রবনতাও কমে না।যৌনায়ন তথা চরিত্রায়নের পর্নোগ্রাফি, ইরোটিকা নিয়ে যে আমাদের লেখকেরা নিজেরাই ট্যাবুতে আছে তা বুঝেই কি বাংগালি পাঠক তার পাঠ প্রবনতা সঙ্কুচিত করে ফেলে।স্তন্যপায়িকে যদি ধুলি, ময়লা, অন্য পাথর মেশানো হিরাখন্ডের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে বলতে হয় হিরাখন্ডটিকে কাম্য ঝলকানিতে আনতে তাতে অনেক কোন তৈরি করতে হবে, অনেক যত্নে তাকে কাটতে, পলিশ করতে হবে, তারপর যত কোন তৈরি হবে, তত তা জ্বলজল করবে।এখন স্তন্যপায়ির মুখে আমি খেউড় বসাবো, তার হাতে ঝান্ডা তুলে দেব, কিন্তু তার যৌনায়িত, পর্নোগ্রাফিক ঝলকানিটাকে সেন্সর করবো, তাহলেতো তার সংলাপ ও পরিবেশগত ঝলকানি থেকে আমি গুরুত্বপুর্ন নিউরোলজি, প্যাথলজি সরিয়ে যা উপস্থাপন করবো তাকে সামাজিক এঞ্জিনিয়ারিং এর ফসল বলাটাই সংগত।

খেউড়, ঝান্ডা, লুঙ্গি, স্যুট, টাই, শার্ট, শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট এসবের সাথে সেই এক্স ফ্যাক্টর প্যাথলজিটাও যোগ করা দরকার।জহির রায়হান থেকে আমরা আর কি পেতে পারতাম তার চেয়েও জরুরি হচ্ছে কি পেয়েছি তার তুলনামুলক আলোচনা/বেহুলা, স্টপ জেনোসাইডের পরিচালকের অত্যন্ত ছোট পরিসরের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসটিতে দেখা যাবে ব্যাক্তির যৌনায়ন উকিঝুকি দিচ্ছে, অর্গল ভাংতে চাচ্ছে।খালি পায়ের প্রভাত ফেরিকেও যৌনায়িত ফেটিশের জায়গা থেকে দেখা যেতে পারে, পড়া যেতে পারে।আবার আলমগির কবিরের সিমান পেরিয়ে চলচ্চিত্রে ঝড় কবলিত নায়িকার ব্রা পরা, ঘাম ঝরা দৃশ্য, শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ এর কামতপ্ত অপেক্ষাও যৌনায়নের অর্গল ভেঙ্গে দিয়ে, যৌন উচ্ছাসের বাধন হারা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।     

উনষত্তরের গন জাগরনের পটভুমিতে চিলেকোঠাতে বসবাসরত অন্তর্মুখি ওসমান, মিছিল মিটিং এ বহির্মুখি হাড্ডি খিজির যে চেতনাকে তুলে ধরে তা সমষ্টিক ও সামাজিক।ভাষার যায়গাতে পুরান ঢাকার খিস্তি বা বগুড়ার আঞ্চলিকতা আসে সেই আবারো সেই সমষ্টিক চেতনার শ্রেনি সংগ্রামের চলক হয়ে।এখন দেখতে হবে যে চেতনার সমষ্টিক সংগ্রামটাই ইলিয়াসের কাছে বিবর্তনের নিয়ামক কি না?দেখা যাচ্ছে তাই এবং প্লট বিকাশে এই সমষ্টিক নিয়ামক পুর্ব নির্ধারিত শর্ত হিশেবে কাজ করছে।ইলিয়াসের পরের গল্পকারদের কারো, কারো তুনে পুর্ব নির্ধারিত তুনের সঙ্খ্যা বেশি হলেও, লক্ষ্যতে হরেদরে তারাও এই সমষ্টিক শর্তে ফাদবন্দি থেকেছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক পাঠকের কাছে তুলনামুলক ভাবে বেশি সমাদৃত হলেও, বিভিন্ন স্তরের মিশ্র পাঠকের কাছে ইলিহাস গৃহিত তা বলা যাবে না।আবার বাংলাদেশে যারা ব্যাপকভাবে মিশ্র পাঠকের কাছে বরনিয় তারাও যে পরিবেশায়নে, যৌনায়নে ব্যাক্তির উচাটনকে চারুলতার দোলনার বাইরে আনতে পেরেছে তাও নয়।আগে যে জগদিশ গুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দির কথা বলেছি, তাদেরকে যে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ, উর্দু রাস্ট্র ভাষা ইত্যাদি খপ্পরে পড়তে হয় নাই, তাও লেখা বাহুল্যা।বাংলাদেশি আশির দশকে যখন চিলেকোঠার সেপাই প্রকাশ পাচ্ছে, তা এ লেখার পটভুমিগত উপজিব্ পাকিস্তানি ষাট দশক থেকে পৃথক নয়।ফলে আমরা যাকে লেখকের পুর্ব নির্ধারিত শর্ত বলছি, তা আসলে অন্য পক্ষের চাপানো শর্তের প্রতিক্রিয়ার বেশি নয়।      

পাঠক ভেদে কারো কাছে মনে হতে পারে যে ইলিয়াস এ অবয়ব অর্জন করেছিল, কিন্তু তা বার বার না ভাংতে পারার কারনে বিরলপ্রজ হয়েছিল।হাসান ও ইলিয়াস তাদের পত্রালাপে নিজেদের ইক্ষনগত ক্রাইটেরিয়া হিশেবে যে 'অস্থি, মজ্জা'র প্রসংগ এনেছিল, সমকালিন অনেক নাটক, কবিতা তার সাথে অবয়বের বিচিত্রতা অর্জনেও পুরোপুরি সক্ষ্ম হয়েছে।কিন্ত ইলিয়াস বা হাসান সেদিকে চোখ দেয় নাই, তা নিয়ে লিখে নাই। এটা এক অর্থে পুরো বাম শিবিরের ইক্ষনগত সমস্যা।যে সমস্যার সঙ্ক্রমনে বাম শিবিরের কবিতা প্রয়াসিরা অস্থি, মজ্জা বলতে বুঝেছে কথিত দ্রোহের কবিতা, আর অবয়বের কবিতা বলতে বুঝেছে কথিত প্রেমের কবিতা।এই ইক্ষন থেকেই তারা তাদের কথিত অঙ্গিকার বা কমিটমেন্ট তৈরি করেছে।এর বাইরে যা কিছু তা মাথার উপর দিয়ে চলে গেল বলে অপপ্রচারও চালু হয়েছে, এই ইক্ষনগত সমস্যা থেকে।

 কিউবিজম
 'উনসত্তর' ,'সামরিক আইন'এর মতো ক্যপশান নিয়ে যে মাইলের পর মাইল পরাবাস্তব, যাদুবাস্তব বর্ননা দেয়া যায় তা আমরা দেখেছি ইলিয়াসের বাইরে, রুশদিতে,মার্কেজে।এরা সবাই লিরিকের ঘাটতি পুশিয়েছে বর্ননায়, নিরিক্ষার বুনোটে।নৈতিকতার উদবৃত্ত পরতে বাস্তবের মাত্রাকে বাধবার এবং তা ঢাকবার প্রয়াসে ইলিয়াস যে-রাজনিতির ছায়ায় বর্ননাকে করে তোলে একঘেয়ে; তা থেকে নিজেকে বাচাতেই মাহমুদুল হকের আশ্রয়, 'কত অল্পে কত বেশি বলা যায়' কৌশল।এটা জোলা ও মোপাসার ভিন্নতার মত।ইলিয়াস নিজে অধ্যাপক হলেও, ওকে নিয়ে অধ্যাপনাসুলভ কাজ হয় বেশি কষালো হয়ে ওঠে; নয়ত বেশ টলটলে হয়ে পড়ে।শ্রেনি সংগ্রামের দ্বিমাত্রিকতায়, ইলিয়াসের অবলম্বিত ত্রিমাত্রিক কুট্টি-খান্দান খান খান হয়ে হারিয়ে যায়।

এই দ্বিমাত্রিক দর্পনের নিগড়ে ইলিয়াস কেন নিজেকে সপেছিল, তা আমাকে বিস্মিত করে, ব্যথিত করে।মানে এই লেখকত সত্যেন সেনের চেয়ে অনেক, অনেক উচু মানের; এরত বিরলপ্রজ হবার বা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিক্ষনে বিচ্চার পাবার কথা নয়।কিন্তু ওর সাথে দুরত্ব তৈরি হয়ে যায় শামসুর রাহমানের; ওর সাথে দেখা হয় না মুস্তফা আনোয়ারের।চিনের দেয়াল যে দুর্ভেদ্য নয় তাত হংকং, ম্যকাওয়ের পাশাপাশি অবস্থানেই বোঝা যায়।ভাগ্যিস দুর্ভেদ্য নয়।মতবাদের একমত্রিকতা থেকে পাশ ফিরতে, নিজের হারানো হৃদস্পন্দনের খোজেই কি ইলিয়াস আমাকে প্রশ্রয় দিতেন?

পেছনে তাকালে বুঝতে পারি মোটা ডাটির, চড়া কালো ফ্রেমের কড়া পাওয়ারের চশমার আড়াল থেকে উপচানো রসবোধের পাশাপাশি অবসাদের চোখা  অস্তিত্ব যে চোরাগোপ্তাভাবে ওর সদাসংগি ছিলো, এক অর্থে যার কিউবিস্ট উপস্থাপনা ছিল ওর উপন্যাসগুলো।কিউবিস্ট বললাম এ কারনে যে চিত্রকর পিকাসোর মত ডোরা মার বা কোন মডেল সামনে রেখে কাজ না করলেও, পুরো সমাজটাই ছিলো ওর জন্য একজন ডোরা মার, যাকে ও দেখতো সেই কড়া পাওয়ারের বেকে যাওয়া বিচুর্ন কোন থেকে।অর্থাত একটা চশমা নয়, বরং বহুসচল কয়েকটি আত্মিকৃত চশমার বাকানো লেন্সে সমকালিনতাকে নিয়ে আসতো বিবৃতিধর্মি সাংবাদিকতার সাদাকালো মাত্রার বাইরে।   

চিরকালিন মহিমা ও পর নির্দেশিত প্রাতিস্বিকতা 
বাংলাদেশের তিব্র অস্থিরতাকে ধারন করবার ক্ষমতা ছিল ইলিয়াসের।কিন্তু রজনিতিক প্রাতিস্বিকতায় ও বেছে নিয়েছিল বদরুদ্দিন ওমরদের নির্দেশনা।সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতির সিমা সরহদ্দে ও বলি দিয়েছিল নিজের প্রান স্পন্দন।আর এখানেই ইলিয়াস নিজেকে বামন করে ফেলেছিল।

আমি পাঠক হিশেবে অবশ্যই ওর কাছ থেকে পেয়েছি ভিন্ন ধরনের প্রকরন।কিন্তু তা ছাড়িয়ে যাবার ক্ষমতা ওর ছিল।ছাড়িয়ে যাবার পর, ছুড়ে ফেলা শব্দগুলোকে ফিরিয়ে এনে চরিত্রদের আরো সংহত করাই আমার কাছে মহৎ গদ্যের শর্ত।দাবা খেলার চাল যতই বেশুমার হোক তা কেবলই চাল।এখানে ইলিয়াসকে আমার দাবার চৌশট্টি ঘরের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্তিত মনে হয়।কিন্তু তারপরেও ‘চিলেকোঠার সিপাই’ইয়ের এই ব্যপ্তি আমার কাছে শব্দের অধ্যাপনাসুলভ অতি-উতপাদনশিলতা মনে হয়।চমকের পর, জ্যামিতির কিউবিজমের পর, দাবা খেলার পর আমি ইলিয়াসে অবসন্ন হয়ে পড়ি।

তবে এটাও দেখতে হবে যে এতরকম জ্যমিতি, ভাষার এতরকম অন্তর্গত চালিয়াতিতে পারংগম না হলে একজন লেখকের পক্ষ্যে চিরকালিন মহিমায় সমর্পিত হওয়াও দুস্কর।যা ইলিয়াসের কাজ নিঃসন্দেহে অর্জন করেছে।

কিল্লার মোড়ের ধানকাট্টি
এক্ষন মনে পড়লো ওর পাইপে ভরে টোবাকো সেবন।আমি একবার বেশ তেরিয়া হয়েই বলেছিলামঃ পাইপে তামাক পাতা না ভরে, শুস্ক মঞ্জরি ভরে সেবন করুন, গাজ়াতে আর যাই হোক ক্যন্সারের ঝক্কি নাই, আমাদের মত নির্ভার ভাষাতে লিখতে পারবেন!

অনেক দুর থেকে যখন ওর পা; কেটে ফেল্বার খবর পেয়েছিলাম, হাভানা তামাকের বিশেষ এক দোকানের সামনে বেশ একটু বেসামাল অবস্থায় হেসে ফেলেছিলাম হো হো করে।কারন জানতামঃ শেষ মুহুর্তে; ঐ পারে কি নিয়ে যেতে চায় জানতে চাইলে ও বলবেঃ পাইপটা!

কিল্লার মোড়ে ধানকাট্টির সাথে বাখরখানি’র নাস্তাপানি সেরে ইলিয়াস হেটে যায়; নির্দ্বন্দ-নিরপেক্ষতায়।



চয়ন খায়রুল হাবিব
ব্রিটানি
৫/০১/২০১০

পোস্টে ঈ, ঊ, ণ, চন্দ্রবিন্দু ব্যাবহার করা হয় নাই।চখাহা।