Sunday, 18 July 2010

বাংলা সনেটের নবায়ন প্রসঙ্গে




বিজন সঙ্কেত : 

সনেট বা চোদ্দপদী হচ্ছে বিভিন্ন ভাষায় পোয়েটিক-লাইসেন্স এবং পোয়েটিক-জাস্টিসের মিশেল গীতলতা। এ মিশেলে পৌছোতে নিবিড় প্রস্তুতি দরকার। 

'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ' প্রকাশের পটভূমিতে, সনেট নিয়ে নিজস্ব ভাঙ্গাগড়ার খেলাটার প্রস্তুতি অন্যদের ধরিয়ে দেবার আগে, বাংলাভাষার বিবর্তনের আলোকে কবিতা প্রচলে সনেটের আভিধানিক অর্থ কোথায়, কিভাবে থমকেছে তা এ-ভাষার কয়েকজন মানি কবির সনেট থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি।

মাইকেল থেকে শুরু করে আজতক অনেকেই অনেক, অনেক বাংলা সনেট লিখলেও; সনেটের বিশ্বায়িত বেশুমার কম্বিনেশনের তুলনায় বাংলা ভাষাতে সমকালীন সমস্ত সনেটই হয়ে উঠেছে নোট মুখস্থ পাশের পড়ার মত! এই মুখস্থ পাশের পড়া প্রকরণের দিকে আঙ্গুল উচিয়েছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম সনেটিয়া মাইকেল মধুসূদন, তার নিচের সনেটে :

মিত্রাক্ষর :

বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি ! কত ব্যথা লাগে
পর' যবে এ নিগড় কোমল চরণে--
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে
ছিল না কি ভাবধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে ?
কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে ?
নিজরূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে !
কি কাজ পবিত্রি' মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে ?
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত-বাসে ?
প্রকৃত কবিতা রূপী কবিতার বলে,--
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ ফাঁসে ?

আনন্দলোক :

এই 'লৌহ ফাঁশ' বন্ধনীটাই প্রথমে আমাকে সনেটের উসিলাতে ভাষা-মুক্তির সাথে সাথে নিজের চেতন, অবচেতন সংস্কারগুলাকেও চিহ্নিত করবার অবকাশ ও উস্কানি দেয়! ভাষা প্রকরণের শিকলে আটকালে যে তার অবস্থা লোহার জুতা পরা চৈনিক মেয়ের বাঁকানো পায়ের নান্দনিকতায় গড়ায়, তা যে মাইকেলের অনেক বছর পর রবীন্দ্রনাথ'কে ভাবিয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে,'নৈবেদ্য', 'চৈতালি' ও 'প্রান্তিকে' ঠাই পাওয়া সনেটগুলাতে! আর সবকিছুর মতই রাবীন্দ্রিক সনেটেও সৃষ্টির খেয়ালটাই প্রধান,  বাককুষলতার আনন্দধারায় প্রকরণ একবারেই গৌণ হয়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সনেটে!

নৈবেদ্য : ২৬ 

এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
যে প্রাণ তরঙ্গমালা প্রতিদিন ধায়
সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে
সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে,তালে লয়ে
নাচিছে ভুবনে, সেই প্রাণ চুপে চুপে
বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে
লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে
বিকাশে পল্লবে পুষ্পে বরষে বরষে
বিশ্বব্যাপী জন্ম-মৃত্যু সমুদ্র দোলায়
দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার ভাটায়
করিতেছি অনুভব সে অনন্ত প্রাণ
অঙ্গে অঙ্গে আমারে করেছে মহীয়ান
সেই যুগ-যুগান্তের বিরাট স্পন্দন
আমার নাড়ীতে আজি করিছে নর্তন

অন্ত্যমিলের দ্যোতনা রবীন্দ্রনাথে এতটাই সহজাত যে একে আর মনেই হয় না সনেটের জন্যই বিশেষ আয়োজন।তবে পংতিবিন্যাসে, অন্ত্যমিলগুলা ধরে ধরে কক, খখ, গগ, ঘঘ,ঙঙ,চচ, ছছ বসায়ে দিলে দেখা যাবে মাইকেল তার সনেটকে গীতলতা থেকে যত দূ, রবীন্দ্রনাথ য্যানো তার অন্যান্য শাখার মুল যে প্রাণস্পন্দন অর্থাৎ সংগীতময়তা তাই ফিরায়ে এনেছিল ওর সনেটে!

কপোতাক্ষ থেকে ইছামতী :

সনেট শব্দটার শুরু ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল আর ইটালির অক্সিটান উপত্যকার ভাষা থেকে : অক্সিটানের সনেট আর ইটালিয়ান সনেটর অর্থ ঘুরেফিরে, 'ছোট শব্দ' বা 'ছোট গান'! অক্সিটান ভাষাতে লেখা সনেটগুলার মধ্যে শুধুমাত্র একটা সমকালীন পাঠকের হাতে এসেছে! ১২৮৪তে লেখক পাওলো লানফ্রান্সিয়া পিস্তোয়া তৃতীয় আরাগনকে একটা যুদ্ধের  খবর জানাচ্ছে এই সনেটে,  যা সংরক্ষিত ফ্লোরেন্সে। এরপর সনেট হয়ে উঠে ব্যক্তিগত উচাটনের বাহন। মাইকেলের মত রবীন্দ্রনাথও তার সনেটে ধ্রুপদী নিসর্গ ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজেছেন ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে! এই খোঁজ মাইকেলে বেশির ভাগ সময় বিমূর্ত আত্মকেন্দ্রিক স্মৃতি খোড়াখোড়িতে গড়ালেও, 'চৈতালি'র রবীন্দ্রনাথে 'তা বিস্তৃত কেন্দ্রাতিত সমাজ সচেতনায়!

মাইকেল : কপোতাক্ষ নদ :

সতত, হে মদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ;
সতত ( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি ) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!---
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা?---যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি ; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!

রবীন্দ্রনাথ : চৈতালি : ইছামতী নদী

অয়ি তন্বী ইছামতী, তব তীরে তীরে
শান্তি চিরকাল থাক কুটিরে কুটিরে—
শস্যে পূর্ণ হোক ক্ষেত্র তব তটদেশে।
বর্ষে বর্ষে বরষায় আনন্দিত বেশে
ঘনঘোরঘটা-সাথে বজ্রবাদ্যরবে
পূর্ববায়ুকল্লোলিত তরঙ্গ-উৎসবে
তুলিয়া আনন্দধ্বনি দক্ষিণে ও বামে
আশ্রিত পালিত তব দুই-তট-গ্রামে
সমারোহে চলে এসো শৈলগৃহ হতে
সৌভাগ্যে শোভায় গর্বে উল্লসিত স্রোতে।
যখন রব না আমি, রবে না এ গান,
তখনো ধরার বক্ষে সঞ্চরিয়া প্রাণ,
তোমার আনন্দগাথা এ বঙ্গে, পার্বতী,
বর্ষে বর্ষে বাজিবেক অয়ি ইছামতী!

'ইছামতী'র সনেটিয়ার যে তার সময়কে 'তাসের দেশ', 'অচলায়তন', 'রক্তকরবী'তে বিদ্ধ করবেন তার সঙ্কেত-সূত্র পাওয়া যাবে 'চৈতালি'র নিচের সনেট'টায়ঃ

চৈতালি : সামান্য লোক :

সন্ধ্যাবেলা লাঠি কাঁখে বোঝা বহি শিরে
নদীতীরে পল্লীবাসী ঘরে যায় ফিরে।
শত শতাব্দীর পরে যদি কোনোমতে
মন্ত্রবলে অতীতের মৃত্যুরাজ্য হতে
এই চাষী দেখা দেয় হয়ে মূর্তিমান,
এই লাঠি কাঁখে লয়ে, বিস্মিত নয়ান,
চারি দিকে ঘিরি তারে অসীম জনতা
কাড়াকাড়ি করি লবে তার প্রতি কথা।
তার সুখদুঃখ যত, তার প্রেম স্নেহ,
তার পাড়াপ্রতিবেশী, তার নিজ গেহ,
তার খেত, তার গোরু, তার চাষ-বাস,
শুনে শুনে কিছুতেই মিটিবে না আশ।
আজি যার জীবনের কথা তুচ্ছতম
সেদিন শুনাবে তাহা কবিত্বের সম।

পশ্চিমের পথবন্ধন :

ইংরেজ শেক্সপিয়ার ও লাটিন পেত্রার্কাকে আদর্শ ধরে নিয়ে; ফ্রান্সে বসবাস করেও যে মাইকেল তার সমকালীন ভিক্টর হুগোদের খোজ খবর নিলেন না; সে-মাইকেলের সনেট থেকে রবীন্দ্রনাথ কি পেলেন?

প্রকরণ যে 'বেড়ি', প্রকরণ যে চিনা মেয়ের পায়ে বাঁকানো লোহার জুতা এই সঙ্কেতসূত্রগুলোকে  আত্মস্থ করেই রবীন্দ্রনাথ তার নাটকগুলাতে, উপন্যাসগুলাতে কবিতা ও গদ্যের সীমাসরহদ্দ ভেঙ্গে ফেলছিলেন। মাইকেল হাত খুলে বিশ্ব ধ্রুপদ ভাণ্ডার থেকে যা নিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তা পুরাপুরি ব্যাবহার করে বাংলা সাহিত্যে যে স্বাতন্ত্র্য ও প্রমিত মানদণ্ডের বাইরে উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের পত্তনি দাড় করায়ে ফেলছেন তার প্রমাণ ছড়ায়ে আছে তার বহু-বিচিত্র, আপাত সহজ লিরিকাল সনেটে!নোবেল পুরস্কার এর প্রমাণ নয়! এই উদ্বৃত্তের সবচেয়ে বড় প্রমাণ স্প্যানিশ ভাষার আধুনিক সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব দেখলে। মৃত্যুর পর নকশালপন্থীরা রবীন্দ্রনাথকে শ্রেণীশত্রু বলে চিহ্নিত করলেও দুঁদে লাল কার্ডধারি নেরুদা তাকে ধারণ করে বসে আছে সেই উনিশ বছর বয়স থেকে!

কেতকীর অনুযোগ :

আর্জেন্টিনাতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে দেখা হবার আগেই রবীন্দ্রনাথ'কে ইংরেজিতে পাঠ করে, আত্মস্থ করে, অনুবাদ করে ফেলেছে 'প্লাতেরো ও আমি'র লেখক কালজয়ী কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথ! কেতকী কুশারি ডাইসনেরা এখানে অনর্থক অনুযোগ করেন যে হিমেনেথেরা স্প্যানিশ পাঠকের কাছে যে রবীন্দ্রনাথ'কে তুলে ধরেছে তা খণ্ডিত এ-কারণে যে ঐ অনুবাদগুলো হয়েছে ইংরেজি থেকে!

কেতকীদের এটুকুই বলা যায়, হিমেনেথের মত কবি নিশ্চয় বাংলা না জানলেও রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ইংরেজি কাজগুলার সাথে পরিচিত হবার দায়টুকু বহন করেছিলেন। এখানে স্মর্তব্য যে 'প্লাতেরো ও আমি' কে স্প্যানিশ সাহিত্যে বলা হয় সার্ভেন্টেসের 'ডন কিহোটের' পর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখা! তার লেখক যখন সে-লেখাতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব গৌরবের সাথে স্বীকার করেন তখন যেটা মনে না হয়েই পারে না তা হ'লো : একটা লেখা যখন শিল্পের দায়গুলা বহন করেই মৌলিক ও যোগাযোগ-নিবিড় হয়ে উঠে, তখন তা ভাষাতাত্বিকের মধ্যস্থতা ছাড়াই অনুবাদেও স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রাখে!যে যোগাযোগ-নিবিড়তা রবীন্দ্রনাথকে হিমেনেথে জারিত করেছিল; বাংলা ভাষা জানা সত্ত্বেও তা আমি পাইনা রাদিচির রবীন্দ্রনাথে, বা ক্লিনটন সিলির জীবনানন্দে!

শেক্সপিয়ার সন্নিধানে :

সনেট থেকে কি প্রক্ষিপ্তভাবে অনুবাদে চলে আসলাম? সবাই না হলেও বাংলা ভাষার সনেটিয়াদের বেশির ভাগই অন্য ভাষার কাজ কিছু না কিছু অনুবাদ করেছে! সরাসরি অনুবাদ না করলেও আত্তীকৃত রূপান্তর ঘটিয়েছে নিজেদের কাজে। কিন্তু সব কবির পক্ষেই আর আর ১০/২০টা ভাষা জানা সম্ভব না।কিন্তু উৎসাহী হলে অন্য ভাষার কাব্য প্রকরণ ও বিবর্তনগুলা জানা যেতে পারে! মাইকেল থেকে বিনয় মজুমদারের ধারাবাহিকতায় সনেটের পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মাইকেলে শুরু হয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে সনেট যেভাবে খুলেছিল, তার পর কবিতায় অন্যত্র ব্ল্যাঙ্ক ভার্সের যথেচ্ছ ব্যাবহার হলেও; সনেটের উপস্থাপনাতে তেমন কোন হেরফের হয় নাই। শেক্সপিয়ারের আয়াম্বিক পেন্টামিটারেরর সাথে যোগ হয়েছে সনাতন অক্ষরবৃত্তের চক্কর!আয়াম্বিক পেন্টামিটারটা কি? এর তাল, লয়, মাত্রার মুলে :

দা দুম

যাকে আয়াম্বিক পাঁচ মাত্রাতে ছড়ালে দাড়ায়:

দা দুম দা দুম দা দুম দা দুম দা দুম

এখন এই 'দা দুম' কে আগে পিছে করেই শেক্সপিয়ার তার কালজয়ী সংলাপগুলা লিখতেন।'দা দুম' সংলাপগুলার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে হ্যামলেট কথনে:

To be or not to be, that is the question

পেত্রার্কা না কি পেতরার্কা?

শেক্সপিয়ারের সনেটও এই দা দুম!কিন্তু সনেট লিখেতো আর কোনই পয়সা জুটেনা! তাই দা দুম'কেই তাক দুমা দুম দুম তাক, আর তার সাথে ব্ল্যাঙ্ক ভার্সের কসরত জুড়ে দিয়ে তা নাটকের সংলাপে নিয়ে আসা! শেক্সপিয়ারের ইংল্যান্ড তাদের বর্ণমালা হিশাবে য্যামন অসংকোচে গ্রহণ করেছিল রোমান হরফ, সেরকম এই তাক দুমা দুম দুমের সঙ্কেতসূত্র বাধা ইটালির সাহিত্য ধারায়! শত শত বছর আগেই দান্তে সনেট লিখে ফেলেছে! তবে সবচেয়ে শক্তিশালী সনেটগুলা, যেগুলা দিয়ে লাটিন সনেটের আদর্শ তৈরি হয়েছিলো, সেগুলার সনেটিয়া হচ্ছে পেত্রার্কা ও মাইকেল এঞ্জেলো!স্মর্তব্য যে আমাদের মাইকেল পেত্রার্কা বানান করেছিলেন, 'পেতরার্কা'!

লাটিন আদর্শে সনেটের প্রথম ৮ লাইনকে বলা হবে ওক্টাভঃ এখানে একটা সমস্যা, প্রস্তাবনা বা ধারনা তৈরি হবে। শেষ ৪ লাইনে সেই ধারনাটার সাথে বৈপরীত্য ঘটাতে হবে! এই শেষ ৪ লাইনকে বলা হবে, সেস্টেট! এখন এই সেস্টেটে যে একটা বৈপরীত্য ঘটবে তার ইঙ্গিত বা মোচড় তৈরি হবে নবম লাইনে! ইটালিও সনেটের প্রবর্তনাগুলা পুরাপুরি নেবার পর ব্রিটিশ সনেটের মৌলিকতা হচ্ছে কাঠামোটাকে ৪/৪/৪ তিনটা পর্বে ভাগ করে শেষ যুগল বা কপলেটে পুরো বিষয়ের সাথে বৈপরীত্য তৈরি না করেই একটা সারাংশ ও নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়া। আর নবম লাইনের মোচড়টা বা ভোল্টাটাও এই যুগল চরণেই সেরে দেয়া!

তিরিশিও সনেট

অনেকে বলে থাকে যে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, প্রমথ চৌধুরীরা ফরাসি কায়দাতে সনেট রচনা করেছে! ফরাসি কায়দাটা যে কি রসগোল্লা কায়দা তা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই! একটা কথা আগে বলেছি যে সনেট শব্দটার উৎপত্তি ইটালির ওক্সিটান উপত্যকা ঘেঁষা ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে!এখন সেই রোমান সাম্রাজ্যে বিরোধী গল সম্প্রদায়ের ওবেলিক্স, এস্টারিক্সের কল্পিত কার্টুন চরিত্রগুলা থেকে শুরু করে সত্যিকারের জোয়ান অব আর্ক অবধি ইউরোপের এই এলাকাগুলোতে শাসক বদল হয়েছে, সাম্রাজ্যের বিস্তার, সঙ্কোচন হয়েছে বার বার। বিভিন্ন অদলবদলেও রেস্টোরেশান, রেনেসাঁ এসবের মধ্যে একটা সূত্র ধরে রেখেছে ভ্যাটিকান।

আদিবাসী ওক্সিটানিদের ছোট ছোট গান ওদের অজান্তেই হয়ে গেছে রোমানদের ও পরে ইংরেজদের দরবারি সনেট। ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে কর্সিকাতে নিশ্চিত ওক্সিটানের রেশ পাওয়া যাবে!আর এ-ভাষা থেকে যদি 'সনেট' শব্দটা এসে থাকে তাহলে লাটিন থেকে আসা ফরাসি ভাষাতে; ইংরেজের ব্যাবহার করা রোমান শব্দভাণ্ডারে নিশ্চয় অনেক অক্সিটান শব্দ লুকায়ে রয়েছে! বাংলাতে য্যামন বুক খা খা, লাঙ্গল, ঝুড়ি ইত্যাকার লুকানো আদিবাসী শব্দ।মোদ্দায় ফরাসিতে ১৬০০ শতকের বিখ্যাত সনেটিয়া রস্যা Ronsard এবং ফরাসি বিপ্লবোত্তর ভিক্টর হুগোর মত জগত কাঁপানো সনেটিয়া থাকলেও রোমান ও ইংরেজ ঘরানার বাইরে তাকে আমার স্বতন্ত্র মনে হয় নি।

রাজনৈতিক অঙ্গিকার যে প্রকরণকে ছাপিয়ে কি তীব্রভাবে কেন্দ্রাতিত হতে পারে তার সাক্ষাত প্রমাণ ভিক্টর হুগোর সনেটগুলা! এদিক থেকেও 'কবিতা' পত্রিকার বোদলেয়ার, এলান পো অনুরক্তদের চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমার অন্তস্থতায় এবং শিল্পের জন্যই শিল্প ধরনের কলা-কৈবল্য ইয়ত্তার বাইরে অনেক বেশি করে হুগোর কাছাকাছি মনে হয়।

তিরিশের বিস্তার :

জীবনানন্দ, বুদ্ধদেবদের কথিত ফরাসি আদর্শের সনেট নড়াচড়া করবার সময়েই আমি আবার বিনয় মজুমদার'কে ঝাঁকিয়ে, ঝাঁকিয়ে পড়তে গিয়ে বুঝতে পাই, বিনয়ের সনেট আমাকে মোটেই ঝাঁকাচ্ছে না। বিনয়ের সনেট পড়বার সময় আমি উন্মুখ হয়ে থাকি রুশ জানা কবির সনেটে পুশকিনের ওনেজিনিও পর্বভেদ দেখতে। পাই না। 'অঘ্রানের অনুভূতিমালা', 'ফিরে এসো চাকা'র' কবি তার সনেটে জীবনানন্দকে প্রণতি জানাতে গিয়ে খুইয়ে বসে আছেন নিজের শক্তি ও স্বাতন্ত্র্য! এরেস্টেড কবিত্বের লক্ষণ বুঝতে বিনয়ের 'ধূসর জীবনানন্দ' সনেটটি দৃষ্টান্ত হতে পারে :

ধূসর জীবনানন্দ :

ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিল, 'এই জন্মদিন'
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল বলে ভেবেছিল, অক্ষমের গান।
সংশয়ে, সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।
এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পুঞ্জীভূত বাস্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত,
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিল, এখনো রয়েছে, চিরকাল
রয়ে যাবে, সংগোপন লিপ্সাময়ী কম্পিত প্রেমিকা-
তোমার কবিতা, কাব্য;সংশয়ে সন্দেহে দুলে দুলে
তুমি নিজে ঝরে গেছ হরীতকী ফলের মতন।

বিনয় তার সনেটে কি দিতে পারেন নাই, তা দেখানোটা একেবারেই অসংগত। তবে কি দিয়েছেন তা থেকেই জীবনানন্দ স্কুলটার একটা সংহত সারাৎসার পাওয়া যেতে পারে। এই সনেট'টাতে দুবার এসেছে, 'সংশয়ে, সন্দেহে দুলে...' আর 'হরীতকী ফলের মতন। 'হরীতকী উপমাটাকে নৈবেদ্য ধরে নিয়ে, আমি বলতে চাই, 'সংশয়ে, সন্দেহে দুলে...' তেই বিনয় নিজের সহ জীবনানন্দ স্কুলের নান্দনিক দর্শনের চৌহদ্দি বেধে দিয়েছেন।

যতই বোদলেয়ার, এলেন পো করুক এই স্কুল, এদের চিন্তাসূত্রের উৎসমুখ হচ্ছে, নিতসে। নিতসের দর্শন যেখানে এসে রিলকের কলাকৈবল্যবাদি মউত কি গোলাতে ঘুরপাক খাচ্ছে, এই স্কুল'টা ঘুরে ফিরে সেখানেই গন্তব্য নির্ধারণ করছে, আক্ষরিকভাবেই! অক্ষরবৃত্তের গাণিতিক পাতন বাদ দিলে আমি এই সনেট'টা থেকে মৌলিক কোন প্রবর্তনা দেখি না! তাহলে কি জীবনানন্দ বোদলেয়ার, এলেন পোতে ঝুঁকেছিলেন প্রকরণের আপেক্ষিক নমনীয়তার স্বার্থে, নিহিত তথ্যের শূন্যতাকে আড়াল করতে?

বিনয়ের সনেটের আরেকটা বড় বৈলক্ষন এখানে ''গণনাতীত পারাবত' জাতিয় জবড়জং শব্দের প্রতি দুর্বলতা! বিনয় যেরকম, সেরকম জীবনানন্দও শব্দ ব্যাবহারে একেবারেই শুচিবাইগ্রস্ত! এখানে আবার এরা নিজেদের ব্রাহ্মণ্যবাদী 'মুদ্রাদোষে' আক্ষরিকভাবেই বন্দী এবং নিহিলিজমেও বিশ্বস্ত না! এহেনো শুদ্ধতাবাদী আচরণের দিকেই মাইকেলের হুশিয়ারি ছিল :

'প্রকৃত কবিতা রূপী কবিতার বলে,--
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ ফাঁসে ?'

ইউজিন ওনেজিন :

কেউ যদি শেক্সপিয়ার, পেত্রার্কার বাইরে গিয়েও প্রকরণগত মাত্রাতেই নিবিষ্ট থাকতে চায় তাদের জন্য পুশকিনের 'ইউজিন, ওনেজিন' একটা ভাল পাঠ হতে পারে।বিক্রম শেঠের The Golden Gate পুরাটাই লেখা ওনেজিও পর্বভাগে!এ-থেকে পুশকিন সনেটের সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতাও বোঝা যায়। শেক্সপিয়ারের পাঁচ মাত্রার দা দুমের বদলে পুশকিন ব্যাবহার করলেন চার মাত্রার দা দুম:

"aBaBccDDeFFeGG'
দা দুম দা দুম দা দুম দা দুম

নারীবাদীরা নিশ্চিত এই পুশকিনিও আগডুম বাগডুমে ক্ষেপে যাবে। এতে ছোট হাতের হরফগুলাকে, বিশেষ করে পাঁচ নাম্বার স্বরাঘাতকে বোঝানো হচ্ছে মেয়েলি; আর বড় হাতের হরফগুলাকে এবং চূড়ান্ত স্বরাঘাতকে বোঝানো হচ্ছে পুরুষালি! এখানে শব্দের প্রক্ষেপণ শক্তি ও পর্ব বিন্যাসেও নমনীয়তা যে বাড়ছে তা বোঝা যায় এলান পোর 'হেলেন' কবিতাটার পাঠে আর বিটলসের 'lucy in the sky with diamonds' গান'টা শুনলে।

দেহছন্দ :

এবার আবার সনেটের সেই অক্সিটানি পত্তনিতে ফেরা যাক: ইন্দো ইউরোপীয় শব্দগুলার বা ছন্দ প্রকরণগুলার পিছনে আছে মূলত নাচের লয়!অধুনা সনেটের যে সমসাময়িক বিবর্তনগুলা স্প্যানিশ ও আইরিশ-ইংলিশে হয়েছে সে-ভাষার কৃষ্টিতেও নাচের বিচিত্রতা উল্লেখযোগ্য!শব্দের আগে প্রতীক! প্রতীকেরও আগে মন্ত্র শুনতে, শুনতে মাথা দোলানো; শিকারের লাফায়, ঝাঁপায় গা গরম করে নেয়া; এভাবেই ফক্সট্রট, ট্যাপ ডান্স, কথ্যক; এভাবেই আদি কৈলাশে ওমকারের আগে কোল, মুন্ডা ওঝাদের উদ্দাম নাচ!বেশুমার দেহছন্দের কম্বিনেশান, সনেটের বেশুমার স্টাইল!

দেখা যাবে যাদের কৃষ্টিতে সামজিকভাবে নাচের চল কম তাদের কাব্য প্রয়াসে অন্যের থেকে নেবার আয়োজন'টা বেশি।যেটা ঘটেছে জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার ও বিক্রম শেঠের সনেট প্রকরণে।এক্ষেত্রে ধ্রুপদী মাইকেল ও নয়া ধ্রুপদী রবীন্দ্রনাথকে অনেকে বেশি স্বাভাবিক ও সহজাত মনে হয়!সনেট ও নাটকের পাশাপাশি রাবীন্দ্রিক গীতিনৃত্যনাট্যও এখানে উল্লেখ্য!নাচের ভারতীয় ও বিদেশি তাল, লয়গুলা রবীন্দ্রনাথ জানতেন বলে ধরে নেয়া যায়।

ভিড়ের ভিতরে একা :

নিজের মত করে সনেট লিখতে আমি প্রথমেই ঠিক করে নেই যে ছন্দকুষলতার বদলে জোর দিব বাককুষলতায়। আর বাককুষলতাকে এখানে খেলাবে আত্তীকৃত দেহছন্দ। রবীন্দ্রনাথের পর বাককুষলতার জন্য আমি চিহ্নিত করি শামসুর রাহমান'কে। দেখতে পাই 'রৌদ্র করোটির' পর হেঁচকা টানে ভাষায়, উৎপ্রেক্ষায়, উপমায় শামসুর জীবনানন্দ ইশকুল থেকে সরে এসেছেন। নিবেদনে, অঙ্গিকারেও শামসুর জীবনানন্দ, বিনয়দের চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্রাতিত!

'অঘ্রানের অনুভূতিমালার' কবি থেকে আমার কিছুই নেবার নেই বুঝে হতাশ হলেও তার প্রতি মুগ্ধতা অমলিন থাকে। অন্যদিকে, 'টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে'র কবি আমার কাছে মুগ্ধতার ছাড়ায়ে হয়ে  উঠে নিত্য প্রয়োজনীয়। ৩0শের সাথে, বিনয়ের সাথে আমি কোন লেনদেনে যেতে পারি না। মুগ্ধতার পর বুঝি যে এখানে আসলে কিছুই ঘটছে না, বরং ঘটনাকে এড়ানোর একটা প্রাণপাত, জবরদস্তি আছে! মাইকেলের বলা, 'লৌহ ফাঁশ'টার রকমফেরে শিকারি কিভাবে শিকারে পরিণত হয় তা আমি বুঝতে পারি বিনয়ের সনেট প্রয়াসী দুর্বল রচনাতে! বুঝতে পারি যে ৫২বিহিন, ৭১বিহিন পশ্চিম বংগের ৬০ ও ৭০ দশক আসলে নয়া ধ্রুপদের জানালাতে উড়িয়েছে বিভিন্ন কাটছাঁটের, বিভিন্ন প্রিন্টের পর্দা! ডালপালা আছে, পাতার দুলুনিও আছে কিন্তু শিকড়ে বাধা না হয়ে ওগুলা  ঝুলন্ত পরগাছা! সনেট হয়ে উঠে ওখানে ভাঙ্গা দর্পণ, অবরুদ্ধ, এরেস্টেড। 
 
ক্রোধান্ধতা ও ভাঙ্গা লিরিকের মোজাইক :

মাইকেলের ধ্রুপদ, রবীন্দ্রনাথের নয়া ধ্রুপদের পর আমার কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে আবুল হাসান, শামসুরের,শহীদ কাদরীর   টোটাল লিরিক। এদের বাককুষলতা তিরিশিও ভাষা থেকে পুরাপুরি সরায়ে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের প্রমিত দাড় করায়ে ফেললেও স্বরক্ষেপে অক্ষরবৃত্তের নির্ভরতা কমাতে পারেনি! যার প্রভাব এড়াতে পারেনি ৬০ ও ৭০ এর কবিরাও! শামসুর, শহীদের টোটাল লিরিককে নতুন মোড় নিতে সহায়তা করে সাইয়িদ আতিকুল্লার, 'বুধবার রাতে'! অক্ষরবৃত্তকে দীর্ঘ কথকতার অনিয়মিত মাত্রায় ছড়ায়ে আবিদ আজাদ শামসুরের টোটাল লিরিক'টাকে আরো সংহত করে তুলে! গদ্যছন্দের স্বেচ্ছাচারে এবং অক্ষরবৃত্তের সনাতন পরাভবে খোলামিল, ভাঙ্গা লিরিক এবং ভাঙ্গা বয়ানের সম্ভাবনাগুলা কখনো পরখ করেই দেখা হয় নাই। নিজের ১৯৮৫-২০০০ এর কাজগুলো 'জুলেখা সিরাপ' সংগ্রহে একত্র করবার পর আমি আমার ভাষা-সার্বভৌমত্বের বিস্তারে খোজ করতে থাকি প্রজ্ঞা ও সজ্ঞার হারানো সীমান্তগুলো!

সেখান থেকে  আমার নতুন লোকনকাচে, নতুন পাঠে  সিমাস হেনে, পল মালদুনদের অনিয়মিত মাত্রার সনেটের পাশাপাশি ভাঙ্গা লিরিকের মোজাইকে সাইয়িদ আতিকুল্লার পরপরই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে সাবদার সিদ্দিকি। ৪/৪/৪/২ তে ঢুকে যায় ৮/৪/২; নিয়মিত দাদরাতে পা ঠুকে, ঠুকে ঠুমরী বাজাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় রুবিক্স কিউব: হাজার, হাজার কম্বিনেশানঃ রেঙ্গুন নদিতে রক্তাক্ত গেরুয়ায় জড়ানো ভিক্ষুর নিষ্ক্রান্ত শরীর, খেয়াল করুন আমাদের হাতে আসা হাজার বছর আগের একমাত্র অক্সিটান সনেট'টাও ছিল রনাঙ্গনের সংবাদ! রক্তপাতের সংবাদকে আমি নিয়ে যাই জাতকের সংবেদেঃ ২০০৭এর অক্টোবারে জেগে উঠে দেহছন্দের নিজস্ব মাপঃ ভাঙ্গা লিরিক, ভাঙ্গা বয়ানে, খোলামিলের শিথিল সনেটঃ তিন মাসে শেষ হয়, 'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ'!


চয়ন খায়রুল হাবিব
১৮/০৭/২০১০
ব্রিটানি, ফ্রান্স