ফেসবুকে জুলেখা সিরাপ পেজে সামনের একুশে বই মেলাতে প্রকাশিতব্য বিভিন্ন বইয়ের বিজ্ঞাপন আসে।রিভিউ তেমন চোখে পড়ে না।লেখকরাও পারস্পরিক রিভিউ এড়িয়ে চলেন, যার ফলে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক পিয়ার্স রিভিউ ধারাটি প্রায় উবে গেছে, যট্টুকু যা সমালোচনা তা হয় দলপাকানো নেটওয়ার্কিং এর বাহবাবাজি বা প্লাজিয়ারিজমের চোথা মারা ভুশিমাল।এসবের ভেতর নাসরিন জয়া হক জুলেখা সিরাপ পেজে তার কড়াপাকের ইংরেজি সমালোচনাসহ ধরিয়ে দিলেন সাদিয়া মাহজা্বীন ইমাম ও পুলক দেবনাথের যৌথ সম্পাদিত , চেতনার উত্তরাধিকার বইটির বিজ্ঞাপন।দ্বিতিয় শিরোনামে লেখা, ভাষা, দর্শন, সংস্কৃতি/কালোত্তীর্ণ পঁচিশটি প্রবন্ধ।নাসরিনের সমালোচনাটি সাদিয়ার বিজ্ঞপ্তি ঘিরে , সুতরাং সাদিয়া বিজ্ঞপ্তিতে কি লিখেছেন তা পড়া যাক :
সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম/৭ -০১- ২০/ ‘’পূর্বসূরি থেকে পাওয়া জড়োয়া গয়না বা স্মৃতি জড়ানো শাড়ি তোরঙ্গ থেকে বের করে দেখার চেয়ে এ আনন্দ অধিক ।
কয়েকটি প্রবন্ধ শতবর্ষী, সর্বকনিষ্ঠটিও প্রায় অর্ধশত বয়সী । সময়কাল অতিক্রম করে এখনো চেতনার উন্মেষ ঘটাতে প্রয়াসী তাই কালোত্তীর্ণ । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহম্মদ সিদ্দিক খান, নরেন বিশ্বাস, প্রবাসজীবন চৌধুরী বা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো মনীষিদের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করে অভিভাবকত্বের কোন সুযোগ নেই । বরং এভাবে বলি, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বাংলা ভাষার এই প্রবন্ধগুলো আজও আমাদের ভাবনার পরিশীলনে গুরুত্বপূর্ণ । সংকলনের অনেক প্রবন্ধই এখন আর সহজপ্রাপ্য নয় ।
সংকলনের কথা জেনে ‘প্রসঙ্গ কথা’ লিখে পাঠিয়েছেন শ্রদ্ধেয় গৌতম ভদ্র ।এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে ।’’
ওপরের বিজ্ঞপ্তিটির ধারালো সমালোচনার ক্যাপশান শিরোনামে নাসরিন লিখেছেন ‘’A Put Off Old Boys Club Essays?Where Are The Women Essayists?’, বাংলা তর্জমাতে দাড়ায়, নিরুৎসাহব্যাঞ্জক ছেলেদের পুরানো ক্লাব মার্কা প্রবন্ধরাশি? নারি প্রাবন্ধিকেরা কোথায়?নাসরিনের পুরো ইংরেজি সমালোচনাটির বাংলা অনুবাদ নিচে দিলাম।মুল ইংরেজি ফাইলের শেষে।*
নাসরিন জয়া হক/৭ -০১ -২০/ ‘’পুলক দেবনাথ ও সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ সংগ্রহ সম্পাদনা করেছে। প্রবন্ধ সংগ্রহটির মুল ভাব কি, সাদিয়া ওনার প্রথম বিজ্ঞাপনে তা পরিস্কার করে বলেন নাই, ** কিন্তু যা লিখেছেন, তার মোদ্দা কথা, পুরাতনি লেখা ঘিরে প্রবন্ধসংগ্রহটি সম্পাদনা করা হয়েছে।যেসব লেখকদের তিনি উল্লেখ করেছেন বা উল্লেখযোগ্য মনে করেছেন, তাদের সবাই পুরুষ।বেদনাদায়কভাবে আশ্চর্জের, সাদিয়া ও পুলক, গত দেড়শো বছরের পরিসরে কোনো বাঙালি নারি প্রাবন্ধিকের খোজ পান নাই!তাদের সম্পাদিত গ্রন্থে যদি কোনো নারি প্রাবন্ধিক থেকেও থাকে, তাকে বা তাদের ওনারা উল্লেখযোগ্য মনে করেন নাই!
এটা কি অলসতা, অজ্ঞতা না কি বয়েস ক্লাব পক্ষপাত, যার ফলে বিবি তাহেরুন্নেসা, নওয়াব ফাইজুন্নেসা চৌধুরানী, শামসুন্নাহার মাহমুদ, কামিনী রায়দের পুলক ও সাদিয়া খুজে পান নাই?রোকেয়া সাখাওয়াত আকাশ থেকে পড়েন নাই।উল্লেখিত লেখকেরা বেগম রোকেয়ার পরম্পরা তৈরি করেছে, এবং একই পরম্পরাতে পাওয়া যাবে আশাপুর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, লীলা মজুমদার, নবনিতা দেব সেন, মল্লিকা সেন গুপ্ত, তসলিমা নাসরিনকে।মনে করিয়ে দিতে হয়, বাঙালি মুসলিম নারি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী(১৯০৭-৩৪), তার স্বল্পায়ু জিবনে প্রাবন্ধিক, কবি ও গল্পকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
সম্পাদকদের একজন হিশেবে সাদিয়া যদি ওনার পুর্বজ নারিদের তুলে ধরতে অতিরিক্ত পথটুকু পাড়ি না দেন, তাহলে ওনার উদ্যস্যে নিয়ে মনে সন্দেহ আসে, লিংগ সমানাধিকারের রনাঙ্গনে ওনার অঙ্গিকার নিয়েও প্রশ্ন আসে।উনি যদি সাহিত্যের পিতৃতান্ত্রিক সান্তনাসুলভতায় সন্তুষ্ট থাকেন, তা শুধু নারিদের সংগ্রামকে অস্পষ্ট করে না, সাথে যেসব সমকালিন পুরুষ লেখক একই অঙ্গিকারের জায়গা থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করেন, তাদের লেখাকেও ঢেকে রাখবার প্রয়াস পায়।
বইটি কি আমি সংগ্রহ করবো?যদিও বইটির বিজ্ঞপ্তি আমাকে পোতায়ে দিয়েছে, তারপরও হয়তো করবো।দরকারি বলে নয়।কিন্তু মনে রাখতে এবং মনে করিয়ে দিতে যে ২০২০ সালে এরকম একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে একজন নারি সম্পাদক তার পুর্বজ নারি প্রাবন্ধিকদের উল্লেখ করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন।বেগম রোকেয়া ওনার কবরে নড়েচড়ে উঠছেন।আমার জন্য এ প্রকাশনাটি বেদনাদায়ক এবং শকিং।এখনো আমাদের অনেক দুরের পথ পাড়ি দিতে হবে।’’
চয়ন খায়রুল হাবিব/৮-০১-২০/আমার বয়ান : অনেকে বলেন যে পেশাগত পরিচয়ে নারি, পুরুষের ভেদ করার দরকার নেই।অনেকে বলেন যে উত্তির্ন লেখক নারি, পুরুষ লিঙ্গের উর্ধে।আমি নারি লেখক, মহিলা লেখক, প্রুষ লেখক ইত্যাদির বিরুদ্ধে, কিন্তু লেখিকা, অধ্যাপিকাসহ আরো পরিচয়বোধক শব্দের পুং ও স্ত্রি বাচকতার পক্ষে।পরিচয়বোধক শব্দগুলোকে একমাত্রিক লিঙ্গে নিয়ে আসলে, সংশ্লিষ্ট সন্ধি, সমাষ, ক্রিয়াপদের বিবর্তনও একমাত্রিকতার দিকে যাবে, শব্দভান্ডারও কমে যাবে।জনসংখ্যার দিকে এগিয়ে থাকলেও, শব্দ ভান্ডারের দিক থেকে বাংলা ভাষা এখনো অনেক ভাষার পিছে পড়ে আছে।বিশ্ব সাহিত্যে বিপুল্ভাবে অনুদিত ফরাসি ভাষা যে কোনো ধরনের পরিচয় বোধকতায় পুং ও স্ত্রি বাচকতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।আমরা যেভাবে এখন পরিচয় বোধক শব্দগুলোর সংস্কার করতে চাচ্ছি, তাকে সংস্কার না বলে পুরুষতান্ত্রিক অভিধানের চাপানো একমাত্রিকতা বলা যেতে পারে।এই চাপানো একমাত্রিক ধারাবাহিকতা থেকে আমরা যখন ভাষা, সংস্কৃতি, চেতনা ইত্যাদি বলছি, বেশ স্বতশ্চালিত ভাবে নারিদের ধারাবাহিক অর্জনগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি।এই এড়ানো প্রক্রিয়ার চরম সিমান্তে এসে আমরা তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসনে পাঠাই, হুমায়ুন আজাদের ওপর শরিরি আক্রমন চালাই।
ধরা যাক, নাসরিন জয়া হকের সমালোচনা পড়ে, সাদিয়া বা পুলক একটা জবাব দিলেন বা এটাকে পাত্তা দেবার যোগ্য মনে করলেন না।আবার কোনোরকম জবাব না দিয়ে পরে কোনো এক সময়ে একই শিরোনামে একটি নারি সংস্করন প্রকাশ করলেন।কিম্বা জনান্তরে জানালেন যে এরকম কিছু একটা করাই ওনাদের অভিলাষ।পক্ষপাতপুর্ন অভিরুচি, অভিলাষগুলোকে আমরা যতটা জোর গলায় ব্যাক্তিক অধিকার বলি, তার বিরোধিতাকে ততটা জোর গলায় আমরা নাকচ ও দমন করি।এসবে আমরা লোকবল, অর্থবলও পেয়ে যাই।এই নাকচ, দমন, দলনের ফলে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও কথিত চেতনা বিকশিত না হয়ে বিপদজনকভাবে সঙ্কুচিত হয়।পক্ষপাতগুলো তৈরি হয় তোয়াজ, তদবির করে নিজের জায়গা তৈরির উদ্যেস্যে।যে তোয়াজ, তদবির করে এবং যাকে করা হয়, এ দুই পক্ষ্য কি বোঝে না এসব উতকোচমুলক সামাজিক আচরন?আমার ধারনা, বোঝার বোধটুকু এরা হারিয়ে ফেলে এবং গোলাপকে জুইফুল বলে ধরিয়ে দিলেও বোঝে না, কারন গোলাপ এরা দেখে নাই।এভাবেই আদাব, খোদা হাফেজের জায়গাতে আল্লা হাফেজ এসেছে।যত আসবে তত ভালো, কিন্তু কোনো আগমন যদি অপরাপর আগামনগুলোর গতি স্লথ করতে বা বন্ধ করতে উদ্যাত হয়, তাহলে তাকে অঙ্কুরে চিহ্নিত করা দরকার।
বিভিন্নজনের বিভিন্ন ধরনের সনদ দরকার, সে অনুযায়ি তারা পাশের পড়া তৈরি করে বা নকলনবিশি করে।সাহিত্যের সিগ্নেচার টিউন তার থেকে ব্যাপকতরো জমিনে দাড়িয়ে থাকে, যাতে নারি, পুরুষ, ভদ্র, অভদ্রের সমান অধিকার।আমরা সক্রেটিসের যতটা খোজ নেই, শাপ্যের ততটা নয়।পাস্তেরনাকের নাম যতবার বলি, আখতামোভার নাম ততটা নয়।হেমিংওয়ে যতবার উদ্ধৃত হয়, ভার্জিনিয়া উলফ ততবার নয়।নাসরিন জয়া যে নামগুলো নিয়েছে চন্দ্রাবতি, ক্ষনার দেশে সে নামগুলো এক দিক থেকে অনায়াস ধারাবাহিকতা, আরেক দিক থেকে প্রবল সিমাবদ্ধতার বিরুদ্ধস্রোতে দাড়িয়ে সে নামগুলো নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।যাদের আমরা গুরু মানছি, তাদের ভুমিকাও এসব বিরুদ্ধস্রোতকে অনেক সময়ে বেগবান করেছে।
কামিনী রায়, বেগম রোকেয়াদের আমল থেকে বিরুদ্ধস্রোত পেরিয়ে যারা এগিয়ে এসেছেন এবং যোগ্যতার নিরিখে উত্তির্ন হয়েছেন, তাদের কাউকে, কাউকে রেওয়াজিভাবে স্মরন করলেও সঙ্কলনগুলো সেই ঐতিহাসিক পিতৃতান্ত্রিক তদবিরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে নাই।এর ছায়া পড়েছে চলচ্চিত্রে, নাটকে, মিডিয়ায়, অপরাপর যৌনায়িত নাদানকিতে।নারি কি শুধু ধর্শন ও অপরাপর নির্জাতনের বিরদ্ধে সোচ্চার থাকবে, না কি সে তার নান্দনিক অনুভুতি প্রকাশের জায়গাটুকু তার মতো বলবে?এখান থেকে আমার সাদিয়া ও পুলকের যুগলবন্দিকে স্বাগত জানাতে ইচ্ছা করে!কিন্তু সে ইচ্ছার অবচেতনা, চেতনা, অধিচেতনার ভারসাম্য থেকে যদি বলি, তাহলে আমরা নাসরিন জয়ার আপত্তিগুলো ফেলে দিতে পারি না।নারিকে রবাহুত দেখানোর প্রয়াসগুলোর ব্যাপারে যেরকম সাবধান হবার আছে, সেরকম এই রবাহুত সিলগালার খোলনলচে পাল্টাবার জন্য যেসব পুরুষ প্রতিরোধি রচনা লিখে তাদেরও আমাদের স্বাগত জানাবার আছে।সতিদাহ, তিন তালাকের অভিশপ্ত ধাপগুলোতে কোনো সাহিত্যিক সেন্সর অবচেতনে কাজ করে থাকলে, সচেতনভাবে তার প্রতিরোধ আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও চেতনাগত সুস্বাস্থ্যের জন্য কাম্য।
স্ববিশেষে স্মরন করিয়ে দিতে চাই অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম কোন ভাষাতে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, আমি বীরাঙ্গনা বলছি!পরিপ্রেক্ষিতগুলো পার হবার জন্য আমাদের পথচিহ্নগুলো, প্রতিকগুলো জানা দরকার, আবার যারা সেসব পথচিহ্নকে ধোয়াশা করে দিয়ে আমাদের খাদে ফেলতে চায়, তাদের চিহ্নিত করাটাও জরুরি।
চয়ন খায়রুল হাবিব
৮/০১/২০
ব্রিটানি