অরি মাতিস, নীল নগ্নতা।Henri Mattise, Blue Nudes। |
সাগর ছোঁয়া, পাহাড় ঘেরা নিস বিমান বন্দর। |
নীল ট্রেন রেস্তোরা, গ্যার দ্য লিওন, প্যারিস। |
নীল নগ্নতা, ইভ ক্লা। |
পুত্র মাতিস নিস থেকে ফিরে আরো জানিয়েছিল ওর নামের মিতা কিম্বদন্তিতুল্য ফরাসি শিল্পী অরি মাতিসের নামে মিউজি মাতিস/মাতিস শিল্পশালাতে দেখা মাতিসের বিপুল শিল্পকর্মের কথা। ১৬ শতকের এক ভবনে নিস পুরসভা গড়ে তুলেছে মাতিস সংগ্রহশালা।
মাতিস এই শহরে বসবাস করেছিল ১৯১৭ থেকে টানা ১৯৫৪সাল অবধি। ১৯৬৩তে সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন হবার পর মাতিস তার বিপুল সঙ্খ্যক কাজ এখানে দান করে, পরে তার বংশধরেরাও এর সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করে। পুরো জীবনব্যাপী মাতিস বিভিন্ন রঙকে খেলিয়েছে বিচিত্রভাবে। ১৯৪১সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হলে অস্ত্রোপচারের পর তার পক্ষে ক্যানভাসে রঙ চড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসময় দীর্ঘকাল শুয়ে শুয়ে মাতিস কাগজ কাচি দিয়ে কেটে কেটে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করতো, যা তার শিল্প জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় বলে এখন বিবেচিত হয়। এই কাটা-কাগজ বা কাট-আউটগুলোতে চড়া নীল রঙের ব্যাবহার লক্ষণীয়। ১৯৫৪ সালে মাতিসের মৃত্যু হয় ৮৪ বছর বয়সে নিস শহরের বাসায়। একই শহরে সিমিয়েজ কবরস্থানে প্রয়াত স্ত্রী আমেলি নোয়েলির পাঁশে তাকে সমাহিত করা হয়।
অরি মাতিস মিউজিয়াম, নিস। |
নীল নিয়ে আমি নিজেও মেতেছি শাব্দিক, নান্দনিক খেলায়,
''নীল আশ্বস্ত হয় শুধুমাত্র অন্যান্য নীলে
নীল বদলে যায় আকাশচুম্বী বিদ্যুতের নীল
কাতর নীল পূর্ণিমা হেঁটে যায়
বাংলার রাজকীয় বাঘের থাবায়
ক্ষিপ্ত বৈশাখের বিক্ষিপ্ত মহামল্লারে
নীলে নীলে নীল নীল-পাহাড়ি মূর্ছনায়
আমার দেহঘড়ির চোদ্দতলায় চোদ্দ নীলের জালা
শিশু নীল সবসময় ঘুমোচ্ছে
নৌনীল ভালোবাসে সাগরে ডুবসাঁতার
তাহলে কোন নীল সবচেয়ে সত্যিকারের নীল
এর উত্তরে নীল রানার বয়ে আনে
মহানীল পদ্মসূত্রের শ্লোক
যখন শেষবারের মতন থামে নীল হৃৎস্পন্দন
যখন ধনুর জাতক চিৎকার করে ওঠে : নির্বাণ নীল''
(রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ /২০০৭/চয়ন খায়রুল হাবিব)
পিকাসোও একটা দীর্ঘ অধ্যায় পার করেছে সব রকম ক্যানভাসে নীলের আবেশে। পিকাসোর সেই অধ্যায় কেন্দ্র করে নীলের আরেক নাম পিকাসো-ব্লু, যাকে মূর্ছনা না বলে, বলা যাবে মেলাঙ্কোলিয়া। সে সময় পিকাসো অন্যান্য অনেক শিল্পীর মত প্যারিসের জেলখানাতে গিয়ে বন্দী মানুষদের ছবি একে রাখতো। আশ্চর্য লাগে যে আকাশের, সাগরের প্রতীকী মুক্ত-নীলের সাথে পিকাসো বিষণ্ণতাকেও নীলাবেশ দিয়েছিল। ইভ ক্লা, পিকাসোর নীল ভাবতে ভাবতে, ক্লান্ত চোখে নিস বিমান বন্দরে যখন আকাশ ও সাগরের নীল দেখছিলাম, তখন নিরাপত্তা কর্মিরা তন্ন তন্ন করে যারা প্যারিসের দিকে চলে যাচ্ছে তাদের হাত ব্যাগগুলো খুলে দেখছিলো, আবার পরিচ্ছন্নতা কর্মিদের কাজের তদারকিও করছিলো। যেখানে পর্যটকের ভিড়, সেখানে মাদকেরও প্রসার, আর এসব নিরাপত্তা কর্মিদের যোগসাজশেই ঘটে থাকে মাদক পাচার।
ভাবতে চাইছিলাম, নিসের যে অপূর্ব নীল, তা কি আমাদের বাইরে না কি ভেতরে? মার্কিন কবি এডগার এলান পো, ফরাসি কবি বোদলেয়ার, বাংলার কবি জীবনানন্দ সরাসরি 'নীল' শব্দটি ব্যাবহার না করলেও সমুদ্র, আকাশ নিয়ে যেসব স্তবকগুলো আমাদের জন্য রেখে গেছে, তা কিন্তু নীলের প্রতি নৈবেদ্য! এডগার এলান পোর 'টু হেলেন' কবিতার শুরুতে আছে,
'Helen, thy beauty is to me
Like those Nicean barks of yore
That gently, o'er a perfumed sea,
The weary, way-worn wanderer bore
To his own native shore.'
(To Helen/Edgar Alan Poe)
হঠাৎ করে মনে হয়, পো'র এই 'নিসিয়া' ফ্রান্সের দক্ষিণের এই নিস শহর। আদতে পো'র 'নিসিয়া' হচ্ছে তুরস্কের পশ্চিম উপকুলের এক প্রাচীন শহর। এডগার এলান পো তে আচ্ছন্ন জীবনানন্দ আত্তীকৃত ভঙ্গিতে লিখেছিলো,
'হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন'
(বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ/১৯৩৫)
একই এডগার এলান পোতে আত্মহারা বোদলেয়ার লিখেছিলো,
'বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ...উঁচুতে…ঐ উঁচুতে...
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।'
(আশ্চর্য মেঘদল/বোদলেয়ার/অনুবাদ, বুদ্ধদেব বসু)
এলান পো, বোদলেয়ার, জীবনানন্দ তাদের কবিতাগুলোতে 'নীল' শব্দটা সরাসরি ব্যাবহার না করলেও, উল্লেখিত প্রত্যেক শব্দ ও চরণের ফাঁকে আমি একটা নীল সাকো দেখতে পাই। সেই নীল সাকো ধরে পো, বোদলেয়ার, জীবনানন্দ সম্পর্কিত হয় অরি মাতিস, ইভ ক্লা, পিকাসোর সাথে। সেই নীল সাকো ধরে নিস, প্যারিস ঘুরে চলে আসি আটলান্টিক তীরে আমার নিবাসে ব্রিটানির কমলাভায়, যা অমর হয়ে আছে পল গগ্যার ক্যানভাসে। পলের সে কমলাভা নিয়ে হবে আরেক বেলা, আরেক পোস্টে!
চয়ন খায়রুল হাবিব
২/০৭/২৩
ব্রিটানি, ফ্রান্স