Monday 17 November 2008

ম্যঞ্চেস্টারে কবি বেলাল চৌধুরীর সাথে


কথা বলতে বলতে শেভ সেরে নিচ্ছেন বেলাল চৌধুরী




বাইরে যাবার জন্য তৈরি


বেলাল চৌধুরীর ছোট বোন সব সময় হাসিমাখা নেহাল'কে মাঝখানে রেখে আমরা ভোজন রসে ব্যস্ত



দ্রস্টব্যঃ এখানে নামের বানান ছাড়া লম্বা ইকার, লম্বা উকার বাদ দেয়া হয়েছে!চাদবিন্দুও!আশা করি বেলাল চৌধুরী আমাকে ক্ষমা করবেন।



রোহিনিমালার ভগ্নাংশেঃ

“অন্য দেশের নাগরিক হয়েও কলকাতার এক অজ্ঞ্বাত কবরখানায়, জবরদখল জমির বাড়িতে, তাও কুড়ি -পচিশ টাকার ভাড়ায় বেলাল যে-ভাবে দিনযাপন করেছে তাতে মনে হয়েছে, এ ছেলে নিশ্চিত কোনও ছদ্মবেশী রাজকুমার।”
অর্ধেক জীবন/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


বেলাল চৌধুরীর কথা প্রথম শুনি ওরই বোনের ছেলে অপু চৌধুরীর কাছে।স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্জন্ত আমি, অপু ঢাকাতে,একই বলয়ে ঘুরপাক খেয়েছি; সেসবের সাথে ১৭/১৮ বছর বয়সে যখন নিশ্চিত হয়ে যাই যে বাংলা ভাষার কবি হওয়াই আমার নিয়তি, তখন আমার কাছে কবি মানষের আদল হচ্ছে হা রে রে রে করা রবিন্দ্রনাথের বাহাদুর ছেলে, জ্যুল ভার্নের সুলতান আর অপুর বাউন্ডুলে বড় মামা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকলেও আমি কখনই বেলাল চৌধুরীর সাথে একান্তে কথা বলা কি কথাই তেমন বলি নি।বাউন্ডুলে হলে কি হবে, বন্ধুর বড় মামাত।তবে সারা জিবনের মুগ্ধতা থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলাম একদিন এ-মানুষটিকে জানতে হবে।আর যখন সুজোগ আসবে তখন কিছুতেই জানতে চাইবনা, বাউন্ডুলে কি, কত প্রকার, বাউন্ডুলেরা ক ছিলিম গাজা খায়, ক পেগ হুইস্কি খেলে বা ধান কাট্টি পান করলে বাউন্ডুলে স্কুলের স্নাতকোত্তর হওয়া যায় ইত্যাকার হাবি জাবি!শুধু শুনব!

আর এ-সুজোগটিই এসে গেল সহসা।বেলাল চৌধুরী অবকাশ জাপন করছিলেন ম্যঞ্চেস্টারে ছোট বোন নেহালের বাড়িতে। অপু নিজেও থাকে খালার বাড়ির কাছাকাছি একই পাড়াতে।হাজ়ির হলাম এবং গ্যট হয়ে বসে যেমন বলা তেমন শুনতে থাকলাম।ক্যমেকোর্ডার সবসময়ই ট্রাইপডে অন করা ছিল, যাতে ধরা আছে বেলাল চৌধুরীর কথাবার্তার পাশাপাশি ওর ছোট বোনের এবং বোন জামাইর নোয়াখালির আঞ্চলিক আন্তরিক বুলি, ওর বোনের মেয়ে এবং অপুর স্ত্রি চখির নোয়াখালি মেশানো ডায়াস্ফরার মিস্টি বাংলা।এসবের আবহে বেলাল চৌধুরীর সাথে প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হওয়া আলাপচারিতা গড়ায় দুই বাংলার এক এপিক কাব্যনাট্যেঃ

বেঃ এই যে বইগুলো তুমি এনেছ, তার মধ্যে “প্রতিনায়কের স্বগোতক্তি” আমি উইথড্র করে নিয়েছি।বইটা একদম এলোমেলো করে ফেলেছে...বানান ফানান ভুল করে। “জয়বাংলা” কবিতাটা আমি টোটালি বদলে ফেলেছি।এরকম আরেকটা বই উইথড্র করে নিয়েছি।এইগুলা আমি আর পড়িনা।

চঃ হা...হা...হা...এই বইগুলো তাহলে কি আপনি Disown করেন নাকি?

বেঃ হ্যা, disown করিত।এত ভুল, ভাবা যায় না!ওগুলোকে খসড়া বলা যেতে পারে।পরে আবার সব rewrite করেছি।তোমরাও দেখছি বানান নিয়ে অনেক কিছু করছ!

চঃ আমরাও!

বঃ এই যে ফ্রিকে করেছ “ফৃ”!ওপর চালাকি!

চঃ কেউ ওপর বলবে, কেউ বলবে তলার!এটাত হবেই!আমার কবিতা মটো হচ্ছেঃ কবিতা লিখতে শব্দ, ছন্দ, ব্যকরন কিছুই লাগে না।তবে লম্বা ইকার, লম্বা উকার, চাদবিন্দু নিয়ে আমার ঘোর আপত্তি আছে।এসবকে বানানরিতি না বলে আমি বিকার ও বিভেদনিতি হিশেবেই দেখি।আমাদের নাক, চোয়াল এখন আর এসবের উচ্চারনের জায়গায় নাই!

বঃ বানানিরিতি যে সবসময় এক থাকতে হবে তা কিন্তু বলছিনা।রবিন্দ্রনাথ, রাজশেখর বসুরা মিটিং করে অনেক দির্ঘ ইকার বাদ দিয়েছিলেন।ওপর চালাকি করেত আর বদলানো যাবে না।

চঃ তা যাবে না।কিন্তু আপনার এই যে খশড়া ছাপাবার প্রবনতা, আর পরে disown করা , এটা অপচয় হলনা?কাগজপত্র মাঙ্গা।পাঠকেরও ভোগান্তি!না কি ছাপানোর সময় ভেবেছেন ঠিক আছে।পরে খুত খুত শুরু হয়েছে?

বেঃ ছাপানোর সময়ও ঠিক ছিলনা।বার বার বলেছি এগুলো ঠিক নেই।তাড়া দিয়ে নিয়ে গেছে।

চঃ আমি যদি এরকম প্রকাশক পেতাম!আমার স্টাইল কাভাফির মত, বুকলেট নিজে নিজেই বের করি;ফলে প্রকাশকের তাড়া নাই।সুন্দর করে বললাম, আসলে প্রকাশকেরা আমাকে পোছে না।যাক, এবার এলোমেলো থেকে একটু সুনির্দিষ্টতায় আসিঃ

আপনাদের পরিবার ঘরোয়া পরিবেশে নোয়াখালির আঞ্চলিক বা মিশ্র চলতিতে কথা বললেও আপনি কথা বলেন, লেখেনও প্রমিত বাংলাতেই।বাংলাদেশি মিডিয়াতে বাচনিক ভাষার মান এতটাই নেমেছে যে তার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকে বলছে যে বাংলা সাহিত্যে প্রথমবারের মত ইতিবাচকভাবে আঞ্চলিক ভাষার আন্দলোন শুরু হয়েছে!এটাও সুন্দর করে বলা।আসলে বয়শুন্যর আর ডয়শুন্যড় এর উচ্চারনভেদ করতে পারছে না, অপারগতাকে আন্দোলনের আস্ফালনে ঢাকতে চাইছে!

বঃ এটাত আগেও ছিল, পরেও থাকবে।লেখক, কবিত তার আশ পাশের শব্দ ব্যঞ্জনা নিয়ে আগ্রহ দেখাবেই।শামসুর রাহমান এরকম কাজ করেছেন এই মাতোয়ালা রাইতে, সৈয়দ শামসুল হক তার নাটক, কবিতায় এরকম কাজ করেছে, আমি তেমন করি নি, ‘রিকসার শহর ঢাকা” কবিতাটায় ঢাকার রিক্সা চালকদের আশ পাশের শব্দ, বাক্যগুলো ধরতে চেয়েছি; তোমার বইতে দেখলাম কয়েকটা কবিতায় সেরকম করেছ; তোমার পরেও এ-নিয়ে কাজ হবে।কিন্ত সবই প্রমিত মানটাকেই শক্তিশালি করবে।

চঃ “বেলাল চৌধুরীর কবিতা” পান্ডুলিপিটার কবিতাগুলো কি এক ঠিকানাতে না কি বিভিন্ন ঠিকানাতে লিখেছিলেন?

বেঃ বিভিন্ন জায়গাতে।

চঃ মানে লেখা বিভিন্নখানে, থাকাটাও কি কোলকাতার বিভিন্নখানে?

বঃ নানা জায়গাতে তখন থাকতাম,বিভিন্ন অঞ্চলে।কোলকাতার কুমারটুলি থেকে শুরু করে...রামকৃশ্ন ঠাকুর যে-বাড়িতে থাকতেন তার পাশের এক বাড়িতে থাকতাম।সেখানেও বিভিন্ন অভিগ্বতা আছেঃযেখানে ইয়েরা কাজ করে...আ...মানে যারা প্রতিমা গড়ে,সেই প্রতিমা-পল্লিতে বসে কয়েকটা লিখেছি।সেখানে কয়েকদিন ছিলাম, তারপর ওখান থেকে চলে যাই পার্ক সার্কাসে, ওখান থেকে বালিগঞ্জ।

চঃ ভাড়া থাকতেন?

বঃ হ্যা, ভাড়া।

চঃ ভাড়ার টাকা আসত কিভাবে?জিবিকাই বা কিভাবে নির্বাহ করতেন?

বঃ প্রুফ রিডিং করে, পড়িয়ে, লিখে।কতরকম কাজ যে করেছি!একবার এক বন্ধু জানালো ওর বাবা বড় পত্রিকার মালিক, আমি কাজ চাইলে ও বাবাকে বলে দেখবে।আমি রাজি হলাম।বন্ধুর বাবার সম্মতিতে হাজির হলাম পত্রিকা অফিসে।
ওখানে সম্পাদক মশাই দেয়ালে টাঙ্গানো ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছে।মন্ত্র টন্ত্র শেষ করে আমার কাছে আসবার কারন জেনে বললেনঃ খেলতে জান?
আমি বললামঃ হ্য, হ্য জানি খেলতে জানি।কি সে খেলা তা বিন্দুমাত্র না জেনেই!তারপর সম্পাদক বল্লেনঃ হকির মাঠে চলে যাও।
কোলকাতায় ইংরেজদের রেখে যাওয়া হকির এ-ক্লাব, সে-ক্লাব , সবই সরকারি বিভাগ বা কোম্পানিগুলোর; খেলা হয়, কিন্তু কেউ দেখতে আসেনা; ফাকা ধু ধু গ্যলারি।আমি ওখানে গিয়ে ধা ধা রোদ মাথায় নিয়ে বসে থাকতাম, ফাকা গ্যলারিতে ট্যক্সি ড্রাইভারেরা জ়ুয়া খেলত।ওদের কারো কারো সাথে বেশ জমে যেত।শক্তিও চলে আসত।ওর সাথে আড্ডা দিয়ে, আর জুয়াড়ি ড্রাইভারদের সাথে গুলতানি করে, রেজাল্ট হলেই ভো চম্পট।

চঃ শক্তি,সুনীলের সাথে আপনার সম্পর্র কিম্বদন্তিতুল্য।কিন্তু চলার পথেত অনেক সাধারন মানুষের সাথেও আপনার ওখানে পরিচয় হয়েছে।এদের কেউ কেউ কি দাগ কেটেছিল?

বঃ হ্যা, হ্যা।এদের কেউ বেচে আছে, কেউ মরে গেছে।আমি এই পরিচয়গুলো নিয়ে লিখেছিও অজস্র।ছাপা হয়েছে, গ্রন্থিত হয় নি।

চঃ কোন কোন লেখার সুত্রে বোঝা যায় কারো কারো সাথে আপনার বিশেষ সম্পর্ক ছিল, মানে প্রেম ছিল!ছিল কি?

বঃ হ্যা ছিল, সবই ছিল।

চঃ কিন্তু নাম কোথাও প্রকাশ করেন নি!

বঃ না করিনি।সেরকম আসলে সম্পর্ক হয় নি।আমার সম্পর্ক, বন্ধুত্ত্ব সবই কফি হাউস থেকে।ওখানে শক্তি,সুনীল আসত।একটা পত্রিকা করেছিলাম “দৈনিক কবিতা” নামে কবিতা সিঙ্ঘসহ।বংগ সংস্কৃতি সম্মেলনের শেষ বছর একটা মজা হয়েছিল।বংগ সংস্কৃতি সম্মেলন আবার revive করা হয়েছে এখন।সুনীল গাংগুলিকে প্রথম দেখি আমি বংগ সংস্কৃতির মেলাতে।সেদিন ওখানে উনি এত আন্তরিকভাবে একটা বক্তব্য রাখেন যে তা আমার খুব ভালো লেগেছিল।ইস্কুল মাস্টারের ছেলে উনি, বাবার হাত ধরে পশ্চিম বঙ্গে এসেছিলেন ।এমেরিকা থেকে ফিরে বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন।তখনো সুনীল গাঙ্গুলি সুনীল গাঙ্গুলি হয় নি।

চঃ “শক্তি” কবিতাটা পড়ে বোঝা যায় যে কোন কোন সম্পর্ক সময়োত্তির্ন।কখন বুঝেছিলেন যে শক্তির সাথে আপনার এরকম সম্পর্ক?মানে হরিহর আত্মা, যেটাকে বলা হয় blood check!

বঃ Right.এত রকম অভিগ্বতার মধ্যে দিয়ে এই সম্পর্ক...এতত বলা যাবে না।

চঃ এত বলতে হবে না, কম করেই বলেন না হয়; শক্তির সাথে আপনার প্রথম আলাপ মনে আছে?

বঃ ওর সাথে 64এর দিকে কফি হাউসে আমার প্রথম আলাপ।ও তখন দাড়ি রাখে।দাড়ি রাখা নিয়েও একটা কাহিনি আছে।তখন কোলকাতায় একটা রায়ট হয়েছিল।রায়টের কারনেই শক্তির দাড়ি রাখা।সেটাই আমার প্রথম রায়ট, হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা।

চঃ নিজ চোখে দেখেছিলেন ঐ রায়ট?

বঃ হ্যা, চোখে দেখা মানে;চোখে দেখা রায়ট, অভিজ্ঞ্বতার রায়ট। আমার জিবনের প্রথম অভিজ্ঞ্বতার রায়ট।ফেনিতে রায়ট হয়েছে, ঢাকাতে হয়েছে।কিন্তু আমি দেখি নি।ঐ 64এর টাই আমার দেখা প্রথম রায়ট।দেশভাগের পর আমি দেশে ছিলাম।রায়ট নিয়ে পত্র পত্রিকায় পড়েছি।না দেখলেও Riot Stricken দের দেশ ত্যগ জানতাম।ফেনিতে ছিলাম, কুমিল্লাতে ছিলাম, কুমিল্লাতে দেবতুল্য শিক্ষকদের দেশ ছেড়ে যাওয়া দেখেছি।এর আগে হিন্দু, মুসলমানের যে একটা প্রভেদ আছে তাই আমি বুঝতাম না।

চঃ “বেলাল চৌধুরীর কবিতা” সংগ্রহটায় “গুপ্তঘাতক” কবিতাটিতে কি ঐ রায়ট ছায়াপাত করেছিল?

বঃ না, “গুপ্তঘাতক” আমার কোলকাতার জিবন।

চঃ এখানে কবিতাকৃতির কথা এসে যাচ্ছেঃ “বেলাল চৌধুরীর কবিতা” পর্বে আপনার অনুসংগুলো ব্যক্তিগত।ঢাকায় ফেরবার পর অনুসংগুলো হয়ে উঠল সামাজিক, রাজনৈতিক।এক্কেবারে দুম!

ব: ঐ আগের অনুসংগগুলো একেবারে off হয় নি।ফিরে ফিরে এসছে।

চঃ “শক্তি” কবিতাটায় তা পুরোপুরি ফিরে এসেছে।কিন্তু সামগ্রিক অর্থেত বদল একটা হয়েই ছিল।

বঃ সেইটেত অনেক পরে, শক্তির মৃত্যুর পরে।মাঝে বিরাট গ্যপ গেছে।এর মধ্যে শক্তি ঢাকায় এসছে, আমি গেছি।

চঃ কিন্তু দৈনন্দিন অনুসঙ্গে ও তখন আপনার জিবনে আর নাই।

বঃ না, নেই।কিন্তু তারপরও দির্ঘ চোদ্দ বছরের কোলকাতার জিবন, সেই প্রমত্ত জিবন সেটাত আমার মধ্য থেকে যায় নি।সেটা কোন না কোন সময় আমি miss করতাম।
ঢাকায় একেবারে নতুন করে শুরু করা, এক্কবারে নতুন।ধরো ঐ সময় যদি আমি বাংলাদেশে না আসতাম, কিম্বা বাংলাদেশে এসে যদি আবার ফিরে যেতাম; তাহলে আমার জিবনটাই পালটে যেত, লেখালেখির জগতেও আমি অন্যভাবে থাকতাম।দির্ঘ চোদ্দ বছরের লেখালেখি, চোদ্দ বছরের পরিচিতি ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম।

চঃ কৃত্তিবাস পত্রিকাটার শুরু কিভাবে?

বঃ এটা সুনীলদার সন্তান।শুরুতে ওর বন্ধু দিপক সাথে ছিল।পরে শক্তি এবং আরো অনেকে যোগ দেয়।সুনীলদাকে বুধ্বিটা দিয়েছিল সিগনেট প্রেসের দিলিপ কুমার গূপ্ত।

চঃ এটা মজার, কৃত্তিবাসের একটা প্রধান অংশই সুনীলকে না জানিয়ে হাংরি আন্দোলনে জোগ দিয়েছিল।শক্তি, সন্দীপনও চলে গিয়েছিল।কিন্তু ঐসব ঈস্তাহারত পড়া যায় না, এতই পচা।সুনীলকে ওরা জানায় নি কেন?

বঃ ইর্ষা, ভয়।সমির আবার সুনীলদার বন্ধু ছিল।“ধর্মে আছি, জিরাফে আছি” নিয়ে শক্তির তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, এক বসায় দশটা কবিতা লিখে ফেলছে। ও বুঝে গিয়েছিল সমির, মলয়দের হাতে লেখা নেই।ও বুঝেছিল যে হাংরিদের সাথে থাকলে ওর কবিতা ধ্বংশ হয়ে ্যাবে।খুব সম্ভবত সেই প্রথম শক্তি সুনীলদার কবিতার ক্ষমতাও বুঝতে পেরেছিল।ও আবার কৃত্তিবাস বলয়ে ফিরে আসে।টাইম ম্যগাজিন বিটদের কথা বলতে গিয়ে হাংরিদের সম্পর্কে বলেছিল।ঐটুকুই। লেখা কই?বোগাস।

চঃ যে সুনীলকে ওরা ওদের সাথে ডাকেনি , জ়েলে নেবার পর তাকেই অনুনয় করছে আদালতে গিয়ে ওদের কবিতার পক্ষ্যে সাফাই গাইতে!

বঃ মলয় ওটা করেছিল।সুনীলদাকে নিজে গিয়ে ও সাক্ষ্য দিতে বলেছিল।ওর জ়েল দন্ড ঠেকাতেই সুনীলদা ওর কবিতাকে উত্তির্ন না মনে করলেও বলেছিল “সার্থক কবিতা”।

চঃ শক্তি কি করেছিল?

বঃ সমির, মলয়দের এক বোনের সাথে প্রেম করেছিল।ওদের অনেকগুলো বোন ছিল।

চঃ নাম কি বোনটার?

বঃ শিলা।

চঃ শিলা রায় চৌধুরি!শক্তির প্রেমিকা!হো হো হো...

বঃ শক্তির আবার প্রেম, ফ্রেম।ফস্টি নষ্টি আর কি!


ম্যঞ্চেস্টারের রাস্তায়...





চঃ কৃত্তিবাস গ্রুপের বাইরে কেউ কি আপানার মনে দাগ কেটেছিল?

বঃ কতজন কতভাবে যে রেখাপাত করেছিল।চিঠি প্রসঙ্গে বলি।তিন জনকে জানি যারা প্রত্যেকের প্রত্যেকটি চিঠির উত্তর দিতেন।রবিন্দ্রনাথ, শিবরাম চক্রবর্তি আর সুনীল গাঙ্গুলি।সুনীলদার একটা ঘরভর্তি হাজার হাজার চিঠি।প্রশ্ন করতে বলেছিলঃ দেখ ভালবেসে এতজন এত চিঠি লেখে।
শিবরাম চক্রবর্তি ছিলেন রাজ পরিবারের ছেলে।কোলকাতায় উনি নানা রকমভাবে থাকতেন, ভবঘুরের মত।ওর একটা আত্মজিবনি আছে “ইশ্বর, প্রিতি , ভালবাসা”।
পড়লে তুমি বাংলা সাহিত্যের অনেক মজার মজার তথ্য পাবে।উনি সিরিয়াস প্রবন্ধ লিখতেন, কবিতা লিখতেন, শিবরামিও যে পান, ঐ যে “মস্কো বনাম পন্ডিচেরি” ওটাত একদিনে তৈরি হয়নি, সময় লেগেছে।
ওনার বাড়ি যখন প্রথম গেছি, আমার মনে আছে সেটা হচ্ছে ঠনঠনে কালিবাড়ির পাশে, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট।ওনার ঘরটা হচ্ছে এক মেসবাড়িতে।তার দোতালাতে উনি থাকতেন।ঘরের দরজায় একটা বিরাট তালা।আর ঘরে ঢুকলে সারা ঘরময় অজস্র রাংতা, ওষুধের মোড়ক খোলা রাংতা, আর চিঠি, পোস্ট কার্ড , এটা সেটা , আর হাজার হাজার চিঠি।
উনি দুটো কাজ করতেন; আনন্দ বাজারে একটা কলাম লিখতেন; দেশেও লিখতেন এক সময় ‘ট্রামে বাসে’; আনন্দ বাজারে লিখতেন ‘অল্প বিস্তর”।সেখানে আমিও লিখতাম, আমার সম্পর্কেও ওখানে মন্তব্য আছে।আনন্দ বাজার থেকে ফিরতেন চিঠির তাড়া নিয়ে, সেগুলোর ছোট ছোট উত্তর লিখতেন আর তা ছাপা হত প্রত্যেক বুধবারে।আমার খুব মজা লাগত যে এই লোকটা এত কিছুর মধ্যেও চিঠির উত্তর লিখে জাচ্ছে!
উনি প্রথমে ঘরে ঢুকে চৌকোনা ব্র্যকেটের মধ্যে শার্ট বা পাঞ্জাবি ঝুলিয়ে রাখতেন।পরতেনও খুব দামি সিল্কের বা টুইলের শার্ট।বাইরে যাবার সময় তালাতে রাখা কাগজে লিখে রাখতেন, “ শিবরাম- ফুচকা খেতে পাচ মিনিট”, “ আলু কাবলি খেতে পাচ মিনিট”; আর কাচের বয়ম ছিল, বয়মে লেখা থাকত “ডালমুট” , “ মাখম” !মাখম লিখতেন , মাখন না! যে যত পার খাও!

চঃ খুব খুটিনাটি মনে আছেত! ফিরি আপনার ঢাকা ফেরায়। হতে পারে যে নতুন দেশে, নতুন শহরে সেতুবন্ধন ছিল ঐ নতুন অনুসঙ্গের রাজনিতি মেশানো কবিতাগুলো।এখানে কি কোলকাতার বন্ধুদের মত ঘনিষ্টতা কারো সাথেই হয় নি?

বঃ না।তবে আগে থেকেই শহিদ কাদরির সাথে বন্ধুত্ব ছিল।বটু মানে মাহমুদুল হকের সাথেও খুব ঘনিষ্টতা ছিল।ওর প্রতিদিনকার ব্যপার স্যপার জানতে পারতাম।ও একটা কেস!

চঃ মাহমুদুল হকের নিউরোসিস ছিল নাকি? ডিপ্রেশান?লেখা ছেড়ে দেবার কোন কারন দেখাতেন কি?

বঃ ও অনেকগুলো লেবেলে জিবন জাপন করত।ওর কথা ছিলঃ মানিক বাবুর পর বাংলা কথাসাহিত্যে আর কিছু লেখবার নেই।এটা ওর মনে বধ্বমুল হয়ে গেড়ে বসেছিল।স্ত্রির সন্দেহবাতিকগ্রস্থতাও মানিকের চরিত্রদের ছকে বাসিয়ে কথা বলত।

চঃ মানিক লিখেছে বলে আর কারো লিখতে হবেনা, এ কেমন ধরনের কথা! তাহলে নিজে লিখতে গেলেন কেন? কমওত লেখেন নাই!

বঃ এসব হয়েছে নিজের লেখার অবস্থান জেনে যাবার পর।আর শ্যমল গংগোপাধ্যায়ের মহা ভক্ত ছিল।শ্যামলও ওর লেখা খুব পছন্দ করত।কিন্ত ঐ মানিক গো ওকে আর কখনো ছেড়ে যায় নি।ওটাই ওর ক্যরেকটার।

চঃ মানে ঐ গো?

বঃ হ্যা, ওর দেখবার ব্যপারটাও ঐ গোয়ের মতই ছিল।ওর বাবা শোনার ব্যবসাটা ওর হাতে তুলে দিল; তাতিবাজারে গিয়ে শোনারুদের সাথে বসে গয়না গড়বার খুটিনাটি হাতে কলমে শিখেছিল।আরো সব অদ্ভুত ব্যপার স্যাপার!

চঃ আপনারা একসাথে নেশার আড্ডায় যেতেন না?

বঃ যা হত ওর বাসাতেই।গাজাটা ও শেষ পর্জন্ত চালিয়েছে।নিউমার্কেটের সামনের বস্তিতে নিজে গিয়েই কিনত এক বুড়ির কাছ থেকে।বুড়িকে ডাকত নানি বলে, বলতঃ
কি দাও নানি, ধক লাগে না।বুড়িরওত খদ্দের ধরে রাখতে হবে।ধুতরা মিশিয়ে দিত।এর মধ্যে ফোনে ওর মেয়ে বললঃ বাবার খুব খারাপ অবস্থা।গিয়ে দেখি রক্ত পড়ে টড়ে বিচ্ছিরি অবস্থা।

চঃ রক্ত কি মুখ দিয়ে নাকি পেছন দিয়ে পড়ছিল?

বঃ আরে পেছন দিয়ে।আমাশা, ডায়রিয়া সব একসাথে।খুবসে গাজা খেয়েছে, তার পর মিস্টি খেতে ইচ্ছে করছে, ঘরে সব সময় মিস্টি থাকে, ঐ দিন নাই, রাতও গভির, বাইরে মিস্টির দোকানগুলো বন্ধ।ফ্রিজ খুলে মধুভর্তি একটা বয়াম খুলে পুরো বয়াম সাবড়ে দিয়েছে।তারপর যে রক্ত পড়া শুরু হল, তা আর থামে না।মহাখালিতে নিয়ে যেতে হয়েছিল।

চঃ ব্যবসাপাতি কেমন চালাত?

বঃ ওদিকে খুব টনটনে ছিল।সব ধনি লোকদের স্ত্রিরা আসত।কার কাছে বিশ লাখের, তিরিশ লাখের জড়োয়া বিক্রি করতে হবে তা লিস্টি করা থাকত।ইন্টার পার্সোনাল স্কিল অত্যন্ত ভালো ছিল।ব্যবসার প্রয়োজনেই পাথর নিয়ে বেশ পড়াশোনা করত, মহাজাতকের সাথেও খুব অন্তরংগতা ছিল।আমরা একসাথে মহাজাতকের কাছে যেতাম।মহাজাতক ব্র্যন্ডিংটা বটুরই অবদান। রাশিফাশি, পাথর নিয়ে ব্যস্ততা দেখে বটুই মহাজাতককে মানানসই পোষাক পরবার পরামর্শ দিয়েছিল।

চঃ ওনাকেত তাহলে মহাজাতকের কস্টিউম ডিজাইনার বলা জেতে পারে!

বঃ অবশ্যই, অবশ্যই।

চঃ এসব অকাল্ট , ফকাল্ট মিলিয়ে আপনারা কি কোন কাল্ট চর্চা করতেন?

বঃ না, এসবের মধ্যে কোন কাল্ট ছিলনা।তবে ওর মারেফতিতে ঝোক ছিল।ওটাও আর সব গোয়ের মতই।ঐসব নিয়ে পড়ত, ঐসবের লোক জনের সাথে মিশত।

চঃ ওনার লেখার ভাষাটা কোথ্যেকে এসেছিল, এই যে অল্প কথার অসাধারন পরিমিতিবোধ?

বঃ ওটা ওদের পরিবার পশ্চিম বঙ্গের যেখান থেকে এসেছিল সেখানকার ভাষা।ঘরোয়াভাবে ওরা ঐ ভাষাতেই কথা বলত।

চঃ লেখকদের বাইরে বাংলাদেশে আপনার ঘনিষ্ট অন্য কোন বন্ধু ছিল?

বঃ ঢাকাতে আমার পুরানো বন্ধু বলতে ছিল নুরুল আমিন।ও ছিল আমার বাল্য বন্ধু।ও C S P অফিসার হয়েছিল।যদিও একই ক্লাসে পড়তাম না, একই ইস্কুলে ছিলাম।ওদের পরিবারটার বেশ পড়াশোনা ছিল।আমরা একসঙ্গে ব্যডমিন্টন খেলতাম, বাউন্ডুলেপনা করতাম।ওর বাবা ছিলেন RMSএর ক্লারিকাল অফিসার।ওরা একটা ভাংগাচোরা বাড়িতে থাকত।এর মধ্যে ওর বাবা ঢাকাতে বদলি হয়ে যায়।ওখানে নুরুল আমিন পড়াশোনাতে খুব ভাল করে।ঢাকাতে আমি ওদের বাড়িতেও গেছি।

এর পর নুরুল আমিনকে আমি আবিস্কার করি চাটগাতে।মাঝে একটা গ্যপ গেছে।চাটগাতে ও তখন কমার্স কলেজে অধ্যাপনা করে।আমরা আড্ডাফাড্ডা দিতাম, নানান জায়গাতে গেছি।তখন ও জ়ানিয়েছিল যে CSP পরিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।পরিক্ষায় পাশও করলো, খুব ভালো কোরলো।পাশ করবার পর নুরুল আমিন বলেছিলঃ প্রথম পোস্টিং যেখানে হবে , সেখানে আমাকেও জেতে হবে, আমরা দুজনে সেখানে থাকব, দু’ বন্ধুতে একসাথে মজা করব।
তারপর somehow আমাদের জিবনের গতি পালটে যায়, আমি চলে যাই আমার পথে, ও চলে জায় ওর পথে।And he was killed in 1971…

চঃ ওহ...উনি কি কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন?

বঃ না তালিকাভুক্ত না।ও ছিল ময়মনসিঙ্ঘের DC, ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল জ়েরা করতে।কথাবার্তা বলে ওকে ছেড়েও দিয়েছিল।কিন্তু তারপর আবার ওকে ডেকে পাঠানো হয় এ-বলে যে “ তোমার কাছে একটা আগ্নেয়াস্ত্র আছে, ওটা ফেরত দিয়ে যাও।” উছিলা আর কি।সবাই তখন ওকে বলেছে যে একবার বাঘের মুখ থেকে বেচে এসেছে, দ্বিতিয়বার যেতে সবাই বারন করেছিল।নুরুল আমিন শোনে নি, গিয়েছে, আর ও ফেরত আসেনি।
নূরুল আমিন তখন বিবাহিত।ওর শ্যলক হচ্ছে মেজর জেনারেল হারুনুর রশিদ।মুক্তিজোধ্বা।ঐ হারুনুর রশিদকেই তখন কতৃপক্ষ হন্য হয়ে খুজছে।ঐ জ়ন্যই নুরুল আমিনকে ডেকে নিয়ে যায়।
ঐ নুরুল আমিনের অনুষ্ঠান আমারা করলাম তিরিশ বছর পরে সেদিন।ওর স্ত্রির সাথে কথাবার্তা বললাম।

চঃ পোড়ামাটি নিতি মনে হয় পাকিস্তানিরা অনেক আগেই গ্রহন করেছিল।৭ই মার্চের ভাষনে মোক্ষম অজুহাত পেয়ে যায়।

বঃ এ-সবের ছক অনেক আগে থেকে কাটা।সেই আগরতলা ষড়জন্ত্র মামলা থেকে।পশ্চিম বঙ্গে সুভাস মুখপাধ্যায়ের মত লোক আমাকে জিজ্ঞ্বেস করছেঃশেখ মুজিব লোকটা কি রকম?আমি আগে থেকে যদ্দুর জানি শেখ মুজিব ছিল সরোয়ার্দি সাহেবের খুব চ্যলা।

চঃ ৭ই মার্চের ভাষনের পর ওসব মনে হয় ধুয়ে গেছিল।

বঃ এক্কেবারেই ধুয়ে গেল।এমন হল যে তাকে পশ্চিম বঙ্গে সুভাশ চন্দ্রের অবতার ভাবা শুরু হল।60, sএ আমি দেখেছি “নেতাজি আসছে...” এরকম আওয়াজ দিলে
এক ধরনের লোক ছিল শিয়ালদহ স্টেশান তোলপাড় করে ফেলত।
হাজার হাজার লোক জমে জেত।কারন অনেকেই তখনো সুভাস বোসের মৃত্যকে মেনে নেয় নি।তার পর শোল বাড়ির এক সাধুকে সুভাসের অবতার বানিয়ে কয়েক বছর প্রবল উন্মাদনা।দৈনন্দিন জীবন disrupt হয়ে যেত এমন সে উন্মাদনা।এই লোকগুলোই মনে করল শেখ মুজিব হচ্ছে সেই সুভাশ বোশের অবতার।

চঃ হিন্দু-মুসলিম রেশারেশির একটা Non Divisive অবতার পাওয়া গেল!

বঃ এ-নিয়েও ঘটনা আছে।আমার মনে আছে, শেখ মুজিবর যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হল, তখন আনন্দ বাজার থেকে সন্তোষ কুমার ঘোশ , ও হচ্ছে পাগলা, শেখের মুক্তি উপলক্ষে Clarion call দিলেন যে নাগরিক সম্বর্ধনা হবে;ব্রিগেড প্যরেড গ্রাউন্ডে শেখ মুজিব বক্তৃতা দেবে, ফিল্ম এক্টররা আসবে...
দুপুর থেকে ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুশ; এক্টর-ফেক্টর আসবে, এই আসবে, সেই আসবে।উত্তম কুমারের তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা।উত্তম কুমারের গাড়িটা এলো।এর আগে যখন মাধবির গাড়ি এলো তখন থেকেই উন্মাদনা বাড়ছে।জনতা উন্মাদ হয়ে গেছেঃগুরু, গুরু, গুরু বলে একটা ঢেউ উঠছে আর নামছে।উত্তম কুমারের ড্রাইভার গাড়ি বাকিয়ে পগারপার।যেসব মহিলা এসেছিল তারাও অবস্থা দেখে পালিয়েছে।কানন বালাকে চোখের সামনে পিশে মেরে ফেলবার অবস্থা, stampede…অজয় কর বলে এক ক্যমেরাম্যন ছিলেন, ফিল্ম-টিল্ম করতেন; অজয়দা বললেনঃ দেখছ কি, বাচাও...ধরো।
কাননবালা দুই গাছের মধ্যে জনতার চাপের মধ্যে stampede.ত সেইখান থেকে তুলে অজয়দার গাড়ির মধ্যে কোন রকমে ছুড়ে ফেলা হল।এই রকমের অবস্থা...
সেইখানে শেখ সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছেন, বল্লেনঃ
আমার নেতা, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু...।আর সাথে সাথে তুমুল করতালি, আকাশ ফাটানো চিতকার।তারপর বলতে থাকলেনঃ আমার নেতা চিত্তরঞ্জন, আমার নেতা শেরে বাংলা...এইসব বলেই জেতে থাকলেন...যেতে, যেতে যেই সোরোয়ার্দির নাম নিলেন...

চঃ কোলকাতার লোকেরা সরোয়ার্দিকেত এক্কেবারে পছন্দ করেনা।
বঃ করেত নাই, ওরা এখনো ওকে বলে সুরাবর্দি।ফোর্টি সেভেনে ডাইরেক্ট একশান ডেতে যে হানাহানি হয়েছিল,সেদিন যদি সরোয়ার্দি না দাড়াত তাহলে মুসলমান সমাজ
একেবারে কচুকাটা হয়ে ্যেত।এই কারনে হিন্দুদের কাছে ও একেবারে খলচরিত্র হয়ে গেল, সেদিন থেকে ওকে ওরা আর পাত্তা, ফাত্তা দিতনা, সুরাবর্দি ডাকা শুরু করলো।

চঃ শেখ যখন সরোয়ার্দির নাম করলেন তখন কি পিন ড্রপ সাইলেন্স?

বঃ পিন ড্রপ মানে...রেকর্ডটা যদি বাজাও তাহলে শুনবে...সব কিছু থেমে গেল।’

আমরা দু’জনই হো হো করে হেসে উঠলাম।

বঃ এই ধরনের ছোটখাটো জিনিস দিয়ে কিন্তু অনেক কিছু মাপা যায়।

চঃ এটাকেত ডায়াবলিকাল ঘৃনার প্রকাশ বলা জেতে পারে।

বঃ হ্যা, ডেফিনিটলি।একদম গেথে গেছে।সরোয়ার্দিকে ওরা কখনো মেনে নেয় নি।ওরা ছিল মেদিনিপুরের ।আব্দুল্লাহ সরোয়ার্দি কোরানের চমতকার অনুবাদ করেছিলেন।একটা গেল।স্যার জাহেদ সরোয়ার্দি ছিলেন হোসেন শহিদের কাকা, উনি ছিলেন কোলকাতা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, কম কথা নাকি!শাহেদ সরোয়ার্দিত ছিলেন মহা স্কলার;জামিনি রায়কে প্রথম চিনিয়েছিলেন উনি;কোলকাতার সবার কাছে, এই যে কমল কুমার মজুমদারের কাছেও শুনেছি, বলছে যে এই যে বিশ্নু দে, ফিশ্নু দে এরা শিখেছে কোথ্যেকে,এরা সব শিখেছে শাহেদ সরোয়ার্দির কাছ থেকে।তা ঐসব ডামাডোলে পরিবারটি একদিকে সর্বোচ্চ এলিট হয়ে গেল, আর কোলকাতায় এক্কেবারে তলিয়ে গেল।

চঃ এই পারস্পরিক অবিশ্বাসৎ এক দিনে ঘটে নি।সংখ্যালঘু যেখানেই সংখ্যাগুরুদের শাষন করেছে, তার ঘাত প্রতিঘাতত থাকবেই।দ্রাবিড় ভারতে আর্জদের আগ্রাসন, তারপর আর্জাবর্তে মুসিলিমদের আগ্রাসন, তারপর ব্রিটিশের শাসন...একটা পর্জায়ে আমাদের ইতিহাসের দোহাই পাড়া বন্ধ করা উচিত নয় কি?

বঃ দু-সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্যদেরই falls prideও কাজ় করেছে।আমি আমার শিক্ষকদের দেখেছি।ওনারা insecured feel করেছে।মেয়েদের ব্যপারটা আছে, ওনারা মুসলমানদের বিশ্বাস করতে পারেন নি।।বিজেতারা সবসময় মেয়েদের ওপর জবরদস্তি করেছে, ছিনতাই করেছে।রোমানরা করেছে, অন্যান্য বিজেতারাও করেছে।হিন্দুদের মনে ঐ সবকিছুই কাজ করেছে।মুসলমানদের প্রতি একটা ভিতিবোধ আগে থেকেই ছিল।

চঃ এসব পার হয়েত পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসিরা ১৯৭১এ পুর্ব পাকিস্তানের উদবাস্তু লাখ, লাখ লোকের প্রতি অতুলনিও আতিথিয়েতা দেখিয়েছিল।

বঃ কোলকাতার বিশাল একটা অংশই ৪৭ এর দেশভাগের শরনার্থি গোষ্ঠি।শিয়ালদার আশপাশের শরনার্থি শিবিরে অনেকে কাটিয়েছে ১৫/২০ বছর।এই যে চিত্রকর যোগেন চৌধুরী, প্যরিসে গিয়েছিলেন, বিখ্যাত হয়েছিলেন,উনিও মানুষ হয়েছেন শিয়ালদাতে।এরা সবাই নতুন উদবাস্তুদের মেনে নিল। একটা রোগ ছড়ালো তখন খুব দ্রুত, কনজিভাইটিস, রোগটার নামই হয়ে গেল জয় বাংলা রোগ।

চঃ এর সাথে কোলকাতার নিজস্ব দারিদ্রত ছিলই।

বঃ সেই দারিদ্রের মধ্যে এরা সপ্তাহে দুই দিন রাইসলেস ডে মেনে নিয়েছিল৭১এ।হোটেলেও ঐ দুই দিনভাত পাওয়া যেতনা।বাংগালির কাছে রুটি কখনোই উপাদেয় না।ত সেই হাজার হাজার আগের ভাসমান শরনার্থি যারা হোটেলে খেত তারাও এটা মেনে নিয়েছিল।

চঃ আপনি কি তখন স্বাধিন বাংলা বেতারে কাজ করতেন?

বঃ সেটাত অনেক পরে।১৯৬৫তে পাক-ভারত যুধ্বের সময় ভারত সরকারের পলিসি অনুজায়ি আকাশবানি কোলকাতার তত্বাবধানে একটা ক্ল্যন্ডেস্টাইন স্টেশান করা হয়েছিল।ওখানে আমরা কয়েকজন স্ক্রিপ্ট লিখতাম, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের সাথে ওখান থেকেই পরিচয়।
২৫ শে মার্চের পরেই দেবদুলালকে দিল্লি থেকে কোলকাতা নিয়ে আসা হয়।পচিশে মার্চের পর পরই সিমান্তের আস পাস থেকে, ঢাকা থেকে যেসব তরুন পালিয়ে গিয়েছিল তাদের নিয়ে দেবদুলাল রেডিও থেকে “সংবাদ সমিক্ষা” নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন। এ-অনুষ্ঠানের জন্য উনি পরে পদ্মশ্রি উপাধি পান।উপেন গংগোপাধ্যায় প্রজোযনা করতেন।

চঃ আপনি ঐ অনুষ্ঠানে কোন স্ক্রিপ্ট করেন নি।

বঃ স্ক্রিপ্ট করিনি।কিন্তু অন্যান্য কাজ করতাম।শরনার্থি শিবিরগুলোতে যেতাম, আনন্দ বাজারে কাজ করতাম।এর মধ্যে এম আর আখতার মুকুল বললেন যে ফজলে লোহানি কোলকাতায়।
এর মধ্যে সতের আঠার বছর দেখা হয় নি।ফজলে লোহানির ব্যপারে আমার এক ধরনের মুগ্ধতা আছে।ওর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম, আধুনিক কবিতার পাঠ আমি ওর কাছেই নিয়েছিলাম।লোহানি ভাইর সাথে আমার একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল, সেই যখন আমি প্রথম বাড়ি পালিয়ে পালিয়ে ঢাকাতে আসা যাওয়া করতাম তখন থেকে।
কোলকাতায় দেখা হবার পর দুজন এক সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম; লোহানি ভাইও আমাকে এখানে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে, আমিও ওনাকে নিয়ে গেলাম বিভিন্ন খানে।প্রথম দিন ওনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সুনিল গংগোপাধ্যায়ের কাছে।লোহানি ভাই ওখানে একটা ভুল করল।আরেক লোক ওখানে লিখত সুনিল গংগোপাধ্যায় নামে, ও লিখত সুনীল কুমার গংগোপাধ্যায় নামে, সে ছিল টেকো।সে “নিল পদ্ম করতলে” নামে একটা কবিতার বই লিখেছিল।লোহানি ভাই বললেন ঃ আপনার “নিল পদ্ম করতলে” পড়েছিত, এই সেই।সুনীলত একটু ইয়ে হয়ে গেল।তার পর ওনাদের সম্পর্কটা, মানে সেদিনের আসরটাই আর জমল না।
এর পর লোহানি ভাই আমাকে নিয়ে গেল এক সিলেটি ভদ্রলোকের বাড়িটে।ওখানেই স্বাধিন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্ল্যন পোগ্রাম হচ্ছিল।এর পর উনি বোম্বে হয়ে লন্ডন চলে জান।বোম্বে থেকে কিছু চিঠি উনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন।
এর মধ্যে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে আমার ডাক পড়ল।ওখানে এক অফিসে ডেকে আগের পরিচিত এক লোক বলোলেনঃ বেলাল, তুমি এই ফজলে লোহানির সাথে ঘোরাঘোরি করছ, ওকেত ইয়াহিয়া খান মরিয়া হয়ে দালালি করতে পাঠিয়েছে।

চঃ এটা কি সঠিক ধারনা ছিল?

বঃ ভুল, আমিত মনে করি ভুল।কিন্তু সামহাউ এটা রাস্ট্র হয়েছিল।যে আমাকে ডেকে নিয়েছিল সে ইন্টেলিজেন্সের লোক।জানতে চাইল, লোহানির সাথে আমার কি সম্পর্ক?তখন তাকে বললাম যে লোহানিরা এই কোলোকাতাতেই বড় হয়েছে।তার বড় ভাই কিরন কুমার নামে বিখ্যাত, “দুখ্যে যাদের জীবন গড়া” নামের ফিলিম করেছে।

চঃ ফজলে লোহানি সম্পর্কে ভারতিয়দের ঐ ধারনা কি পুরো নয় মাশই ছিল?

বঃ পুরো নয় মাস কোথ্যেকে? লোহানি চলে গেছে ইংল্যন্ডে।ও ততদিনে লস্ট কেস। এত দ্রুত সব ঘটছে,একের পর এক উত্তেজক খবরের তলে লোহানির খবর চাপা পড়ে গেছে।
আমি তখন জড়িত হয়েছিলাম বিজু পাটনায়েকের মেয়ে গিতা মেহেতার সাথে।উনি কাজ করত এক এমেরিকান পাব্লিশার্সের সাথে।গিতা মেহেতা যেত বর্ডার, ফর্ডারে, ছবি তুলত, তুলে পাঠাত এমেরিকান এক ম্যগাজিনে।তখন আমি কিছুদিন গিতা মেহেতার সাথে কাজ করতে বর্ডারে গিছিলাম।

চঃ গিন্সবার্গের “ অক্টোবর অন জেসর রোড” কি এ-সময়ের?

বঃ না, এসব ঘটেছে তার অনেক আগে।ন’মাসত কম সময় না।

চঃ আল মাহমুদ , গুন ওরা কখন এসেছিলেন?

বঃ ওরাও অনেক পরে এসেছিলেন।

চঃ রফিক আজাদ যে মুক্তি্যোধ্বা বলে নিজেকে দাবি করেন, তার সত্যতা কতটুকু?

বঃ না, যেটা শুনেছি সেটা নয়।ওরা হল টাঙ্গাইলের, কাদের সিদ্দিকি ওখানের।সেই সুত্রে একটা সম্পর্ক ছিল।

চঃ মুক্তিযোধ্বা বলতেবা গেরিলা বলতে আমরা যে-রকম মানে জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি তার সাথে রফিক আজাদকে মেলানো যাবে কি?

বঃ বলা মুশকিল।রফিক আজাদের শ্যলক শহিদ, প্রথম ভাবির ভাই, উনি রক্ষি বাহিনিতে জয়েন করেছিলেন; he was a freedom fighter.Real freedom fighter.
শহিদ যখন যুধ্ব শেষে ফিরে আসে, ওর হাতে বন্দুক, টন্দুক ছিল।ও যখন রক্ষি বাহিনিতে গেল, তখন বলেছিল যে অস্ত্রগুলো নিচে থাকুক।রফিক আজাদ সেখান থেকে একটা নিয়ে মুক্তিযোধ্বা হয়ে গেছে!
আমি রফিক আজাদকে চিনতাম, কোলকাতা যাওয়ার আগে শহিদ কাদরি আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলঃ টাঙ্গাইল থেকে এসছে, কবিতা-টবিতা লিখছে, বেশ প্রানবন্ত যুবক।

চঃ অস্ত্র হাতে নিয়ে ওনার মনে হয় নিজেকে বেশ বির্জবান মনে হত!

বঃ হ্যা, এখন বলে “ আমি মুক্তিযুধ্বের সমান বয়সি”!

চঃ এটা নিয়ে কখনো ওনার সাথে আপনি জোক করেন না?

বঃ রফিক আজাদের সাথে জোক করার সম্পর্ক আমার নাই।

চঃ আপনাদের পরিবারে দেখা জাচ্ছে, আপনার যে বিশ্বাস ও জিবন-জ়াপনের জায়গাটা, আপনার ছোট ভাই গিয়াস কামাল চৌধুরী তা থেকে একেবারে ভিন্ন জায়গাতে!আবার আরেক ছোট ভাই জ়িয়াউদ্দিন নিবেদিত কমিউনিস্ট কর্মি।মেরুকরনগুলো খুবই বিশ্ময়কর!


বঃ এটা হোয়েছে up bringing এর ভিন্নতা থেকে।একেক সময় একেকজন হয়েছে।আমি যেমন বাড়িতে ছিলাম না,আমাকে ফুপুর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।আমার unhappy childhood.ফুপু ছিলেন অশিক্ষিত, ফুপা শিক্ষিত।এসবের মধ্যে অন্যান্য ভাইবোনের মত আমার ধর্মিও শিক্ষা হয় নাই।

চঃ আপনি ছোটবেলায় যে ফুপার কাছে ছিলেন, উনি মনে হয় আপনাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল।

বঃ ফুপা খুব পড়ুয়া লোক ছিলেন।যদিও উনি শুধু এন্ট্রান্স পাশ ছিলেন।উনি সেই কালে ডেপুটি ম্যজিস্ট্রেট হয়েছিলেন।ইন্টেলেকচুয়াল পরিধিটা ওনার সাঙ্ঘাতিক উচু ছিল।মনে আছে যে উনি ট্রেজারি অফিসার হয়েছিলেন।আগে বলেছি উনি সাব ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হোয়েছিলেন; এত ভাল ইংরেজি জানতেন, সেই কালে ওনার একটা রায়ের ওপর স্টেটসম্যন পত্রিকার থার্ড এডিটরিয়াল লেখা হয়েছিল।বুঝতে পারছ , কিরকম একটা erudite লোক ছিল।মুক্ত মনের ছিলেন, আর পশ্চিম দিক বলে কোন দিক চিনতেন না।আমার মানষ গঠনে ওনার সাহাজ্য একটা বিড়াট ব্যপার, প্রথম জিবনের ভিত।হিন্দুদের সাথে ওনার লেনদেনগুলো আমি কাছ থেকে দেখেছি, ওখানে কোন সাম্প্রদায়িকতা ছিলনা।কিন্তু পাকিস্তান আমলে হয়ে গেল কি সব কিছুর দোশ হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হল, বিশেষ করে ওদের জমি দখল করাটা চল হয়ে দাড়িয়েছিল।

চঃ কিন্তু বাবা মায়ের সাথে থেকেও জ়িয়াউদ্দিনত খুবই সক্রিয় কমিউনিষ্ট।

বঃ জিয়াউদ্দিনের ওপর আমার প্রভাব পড়েছে খানিকটা, আমিও কমিউনিস্ট পার্টি করতাম, জেলে ছিলাম, এসব জিয়াউদ্দিনকে প্রভাবিত করেছে।

চঃ কিন্ত গিয়াস কামালকে প্রভাবিত করেনি!

বঃ ওকেও করেছিল।আমি জখন জ়েলে ছিলাম ও প্রগতিশিল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল।এখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে , সময় আর সংগ পালটে গেছে, ও বদলে গেছে।

চঃ বাংলাদেশের পুরানো পরিবারগুলোতে এরকম উল্টোপাল্টা দেখা ্যায়ঃ এনায়েতুল্লাহ খান একদিকে, রাশেদ খান আরেকদিকে;গোলাম মুর্শিদ একরকম, গোলাম ফারুক অভি আরেক রকম! কাজি মোতাহার, শহিদুল্লাহ কায়সার,কবির চৌধুরীদের পরিবার এদিক থেকে একটু consistent; আকাশ, ফেরদৌসি মজুমদারত ঐ পরিবারেরই, এরা মোটামুটি একই মঞ্চ থেকে কথা বলে।

বঃ না ঐ শেষেরটায় ফাক আছে

চঃ আছে নাকি?

বঃ আছে।ফেরদৌসি মজুমদারের একটা বই বেরিয়েছে, আত্মজিবনি মত।ঐ বইটা আমি পড়লাম।ওখানে সব কিছু আছে, বাবার গল্প আছে, মায়ের গল্প আছে, ভাষাও সুন্দর। কিন্তু রামেন্দুকে বিয়ে যে করেছে, বিয়ের পর্বটা ধোয়াশা, পরিস্কার করে কিচ্ছু বলে নি!সেই সমাজে এ-বিয়ে থেকে যে অভিঘাত তৈরি হয়েছিল, সেটা হবেই।এমনি উদার মনে হয়েছে, ভাইরা সাহাজ্য করেছে, বোনেরা সাহাজ্য করেছে সেসব আছে, কিন্তু মুল ব্যপারটা, যে সেই সমাজ রামেন্দুকে কি মনে করেছিল, convert হয়েছিল কি হয় নি, সেসব কিচ্ছু নেই।

চঃ এরকম আমাদের সময় ঘটেছিল “সকাল সন্ধ্যার” লেখক মমতাজ হোসেনের ছেলে মিঠুর বিয়ে নিয়ে।

বঃ মমতাজ হোসেনের ভাই চলচ্চিত্রকার আলমগির কবির ছিলেন আমাদের বন্ধু।

চঃ দেখেন কারবার।মিঠু পড়তেন চারুকলায়, বিয়ে করেছিলেন কনক চাপা চাকমাকে।যদ্দুর তখন জেনেছিলাম মমতাজ হোসেন নাকি কনক চাপাকে গ্রহন করেন নাই!আশ্চর্জ!

বঃ এটা সাধারন জিনিসঃ ছেলে প্রেম করে বিয়ে করেছে, করতেই পারে।মানুষকে মানুষ হিশেবে গ্রহন করবার শিক্ষা পায় নি।মানিকছড়ির রাজার সাথে আমাদের খুব বন্ধুত্ব ছিল।ঐ যে বটু, মাহমুদুল হকসহ ওখানে যে কতবার গেছি।রত্না ভাবি বিমানে কাজ করতেন, উনি ছিলেন চাকমা রাজকন্যা।উনি বিয়ে করেছিলেন আমাদের সালাউদ্দিন ভাইকে।ঐসব সুত্রে মানিক ছড়ির রাজাকে আমরা পিশে মশাই ডাকতাম।সেই সময় আমাদের জনগোষ্ঠির কাউকে ওখানে দেখি নাই।তারপর নোয়াখালি, চট্টগ্রামের মানুষকে ওখানে পুনর্বাসন করা হোল।
এখন অরন্যে গিয়ে আর অরন্যের মানুষ নেই।সেখানে নোয়াখালির, চট্টগ্রামের কতগুলো কল কল, খল খল করছে, এই করছে, সেই করছে...বিশাক্ত করে দিল।এটা যে কত বড় অন্যায় হয়েছে।

চঃ এই অন্যায় নিয়ে তেমন কথা হয় না।আমি একটা সময় রাঙ্গামাটির মোনঘর আশ্রমে সময় কাটিয়েছিলাম।ফ্রান্সের ব্রিটানিতে বহু বছর আগে দেখা হয়েছিল চারুকলা থেকে মধ্য আশিতে পাশ করা সুনিতি কুমার চাকমার সাথে।ওর স্ত্রিও ফরাসিনি।ও বলেছিলঃ আপনাদেরকেত আমি পছন্দ করতে পারি না।শাহাবুদ্দিনের ওপরও নাখোষ।

বঃ হবেইত।আমরা ঠেলে দিয়েছিত।শেখ সাহেবও ভুল করলেন, বেতবুনিয়াতে বললেনঃ এইখানে বাঙ্গালি ছাড়া আর কারো স্থান নাই, আপানারা সবাই বাঙ্গালি হয়ে যান।এটাত একটা ব্লান্ডার, অন্তত শেখ সাহেবের ষ্ট্যটাসের একজন নেতার এটা বলা উচিত হয় নি।

চঃ ব্রিটিশরা এত ছলাকলা করবার পরও ওয়েলশদের ভাষা, কৃষ্টিতে হাত দেয় নাই।

বঃ আমাদের উচিত ছিল ওদের টেনে আনা, ওদের শিক্ষানিতি, সবকিছুতে সাহাজ্য করা।আমরা যখন গিয়েছি ওরা যে কিভাবে আমাদের টেনে নিয়েছে।আমি মুরংপুর গ্রামে দিনের পর দিন কাটিয়েছি।সতের আঠার মাইল দূরে নদি পথে ট্রেক করেছি।একটা মং মেয়ে একবার গাইড ছিল, নাম কল্পনা।ও আমাকে চিঠি লিখতঃ তুমি আস,
বেড়িয়ে যাও, থাকো আমার সঙ্গে।বহুবার লিখেছে, somehow যাওয়া হয়নি।সে হারিয়ে গেল, মানে ওকে মেরে ফেলা হয়েছে।
রোহিনিমালা নামে একটি মেয়ের সাথে আমার খুব রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।অনেক কিছু হতে পারত।সেই কবে সেটা!

চঃ কত সালে ওটা?

বঃ ষাট সালে, না তারও আগে, আইউব খানের আগে।

চঃ তাহলেত সবে কৈশর পেরুনো।

বঃ হ্যা, আমার সাথে সৈয়দ জাহাঙ্গির গেছে, রশিদ চৌধুরি গেছে, আমরা একসাথে বেড়িয়েছি।এমেরিকান এক টেলিভিশান কোম্পানি এসেছিল, ওদের সাথে কাজ করেছি।একরাতত পুরো একা কাটিয়েছি।সেই মধুর দিনগুলোত কখনোই ভুলি নাই!

শনিবারে এখানে একনাগাড়ে কথপোকথন শেষ করি আমরা।রোববারে চলে বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা, শনিবারের কথাগুলকেই ঝালিয়ে বিস্তৃত করে নেই।বিকালে অপুসহ বেলাল চৌধুরী আমাকে ম্যঞ্চেস্টার পিকাডিলি স্টেশানে পৌছে দেন।লন্ডনের পুরো পথে আমি বেলাল চৌধুরীর বলা গল্পের ভেতর গল্পগুলো শুনতে শুনতে বুঝতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কেন ওর আত্মজিবনিতে লিখেছিলঃ বেলালের মত মানুষদের কোনও বিশেষ দেশের সীমানায় গন্ডিবদ্ধ করা যায় না, এরা সারা পৃথিবীর নাগরিক।

চয়ন খায়রুল হাবিব

অক্টোবার/২০০৮
ম্যঞ্চেস্টার

ছবিগুলো আমার , অপু চৌধুরী ও রাফায়েল চৌধুরীর তোলা