Sunday, 14 July 2024

মিশ্রকলা : এস,এম সুলতান, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানের সমবাহু ত্রিভুজে।

ঘুরতে ঘুরতে  নড়াইলের মাসিমদিয়া উল্টোরথের লগ্নে!


আগামীকাল সকালে  লাল মিয়া ওরফে কিম্বদন্তীতুল্য চিত্রশিল্পী এস,এম, সুলতানের জন্মস্থান নড়াইলে যাবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলার অধ্যাপক সুশান্ত অধিকারীর যাত্রাসঙ্গী হয়ে নড়াইল যাচ্ছি। প্রথমে গিয়ে উঠবো সুশান্তের বড় ভাই বলদেব অধিকারী বাড়িতে, যে বলদেব সরাসরি সুলতানের কাছে আঁকাজোখা শিখেছিলেন এবং জীবন বায় করেছেন বয়ানধর্মি চিত্রকলায়। বলদেবদার বাড়িতে উল্টোরথের লগ্ন শেষে চলে যাবো আরেকটু দূরের সুশান্তের আরেক বড় ভাই শঙ্করদার বাড়িতে। শঙ্করদা যাত্রা পাগল মানুষ এবং এখনো যাত্রাপালা করে বেড়াচ্ছেন। আগামী কয়েকদিন বলদেব দা এবং শঙ্করদার যাপিত জীবন দেখবার পাশাপাশি ঘুরে বেড়াবো সুলতানের জন্মগ্রাম মাসিমদিয়ায়।

শেখ মোহাম্মদ সুলতান ১০ আগস্ট, ১৯২৩ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলা, ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসেবে  ২০২৪এ তার ১০১ বছর জন্ম জয়ন্তী। এই ১০১ বছরে সুলতানের সাথে চাক্ষুষ সাক্ষাত, কথাবার্তা হয়েছে সাকুল্যে একবার, তাও যেখানে দেখা হবার নয়, সেরকম এক অভিনব জায়গাতে। শ্রদ্ধাপ্রতিম আলোকচিত্রি নাসির আলী মামুন, প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মালিক আবুল খায়ের লিটুর মত আমি সুলতানের খ্যাতিকে ধাওয়া করি নি। সুলতানের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো ঠিক তখন যখন আমি স্থায়ীভাবে দেশ ত্যাগ করতে যাচ্ছি তখন। তার বর্ণনায় যাচ্ছি শেষে। সুলতানকে নিয়ে অনেক তথ্য এখানে, সেখানে পাওয়া যাবে। তথ্য দেয়াটাও এখানে আমার লক্ষ্য নয়। বরং আমি দেখাতে চাইবো, মিশ্রকলার তুলনামূলক আলোচনায় কিভাবে সুলতানের কাজকে আমরা আল মাহমুদ এবং শামসুর রাহমানের কবিতার সম্পূরক করে, একটি নান্দনিক সমবাহু ত্রিভুজ কল্পনা করতে পারি।  

*''নন্দনতত্ত্ব দর্শনের একটি শাখা যেখানে সৌন্দর্য, শিল্প, স্বাদ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি ও উপভোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়। আরও বৈজ্ঞানিকভাবে বললে হয় নন্দনতত্ত্ব মানুষের সংবেদনশীলতা ও আবেগের মূল্য ও অনুভূতি ও স্বাদের বিচার নিয়ে আলোচনা করে।  আর একটু স্থূল বা বৃহৎ অর্থে বিশেষজ্ঞরা বলেন, নন্দনতত্ত্ব শিল্প, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে সূক্ষ্ণ ও সমালোচনামূলক-ভাবে আলোচনা করে।..... 

নন্দনতত্ব এবং সৌন্দর্জতত্ব পারস্পরিক, এর প্রায়োগিক ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ সব যুগেই পাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে সৌন্দর্য সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা; অপরটি ভাববাদী। ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব সৌন্দর্যকে অতি-প্রাকৃতিক একটি সত্তা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অতি-প্রাকৃতিক এই সত্তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং সিদ্ধির অতীত। সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই মাত্র এই নিকষ সুন্দরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এরূপ ব্যাখ্যায় ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং সুন্দরের ধর্মীয় রহস্যবাদী কল্পনায় কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার মোহ আবদ্ধ রাখার প্রয়াস সমাজের শক্তিমান শ্রেণীগুলো সব যুগেই করে এসেছে। সৌন্দর্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শনের অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নের ন্যায় ভাববাদের বিরোধী ব্যাখ্যা হচ্ছে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মানুষের বাস্তব পরিবেশ এবং জীবনের মধ্যেই সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি এবং বিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধ সমাজের শোষক এবং শোষিতের বাস্তব বিরোধের ভাবগত প্রতিফলন।''*

ওপরের সংজ্ঞাকে যদি আমরা আড়াআড়িভাবে সুলতানের ক্যানভাসের ওপর বসাই, আবার শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের বড় রচনাগুলোর ওপর রৈখিকতায় স্থাপন করি তাহলে দেখতে পাবো ভাব এবং বস্তুবাদের মিশেলে শামসুর, মাহমুদের চরিত্রদের পূর্বপুরুষ সুলতানের ক্যানভাসে জীবন যাপন করছে। ভাববাদ, বস্তুবাদে শামসুর এবং মাহমুদে পার্থক্য থাকলেও সাযুজ্য পাওয়া যাবে খোজার চেষ্টা করলে। মাহমুদের 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো', 'আরব্য রজনীর রাজহাঁস', শামসুরের   'নিরালোকে দিব্যরথ', 'ইকারুসের আকাশ' ব্যঞ্জনায়, অলৌকিকতায় খুব কাছাকাছি। আবার দুজনেই তাদের কবিতায় বয়ানধর্মি দৈনন্দিনতায় আক্রান্ত, শামসুর মাহমুদের চেয়ে একটু বেশি হয়তো। চিত্রশিল্পী সুলতান শামসুর, মাহমুদের আগের লোক হলেও বয়ানধর্মিতা এবং পেশল অতিলৌকিকতা তার শিল্পকর্মের প্রাণ-ভোমরা। সুলতানের বহুল পরিচিত আদম সুরত চরিত্রটিকে শামসুর এবং মাহমুদের যে কোনো রোমান্টিক কবিতায় বসিয়ে দেয়া যায়। এরা তিন জনই বয়ানে এপিক বা মহাকাব্যধর্মি, বুনটে প্রগাঢ়ভাবে রোমান্টিক। শামসুর, মাহমুদ তাদের এপিক লিখেছেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে কলমের কালিতে, সুলতান ক্যানভাসে তার এপিক এনেছেন রঙ তুলিতে। মাহমুদ, শামসুর এবং সুলতানের পারস্পরিকতা সেই লক্ষ্য অর্জন করেছে যা একাধারে কবিতা লিখে, আঁকাআঁকি করে অর্জন করেছিলেন উইলিয়াম ব্লেক, ভিক্টর হুগো।

শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের কোন কবিতা সংগ্রহ কার আগে সেসব অযথা বিতণ্ডা না এনে এই সাজুয্যগত রৈখিকতা আনা যেতে পারে এবং নান্দনিক বা সৌন্দর্জতাত্বিক সেই রৈখিকতায় এস, এম, সুলতানের আকা জমিনগুলো বসানো যেতে পারে। এখানে আমি তিনজনের একজনকেও অপেক্ষাকৃত বেশি গ্রামীণ বা নাগরিক বলতে রাজি নই। এরা কাজ করেছেন নন্দন এবং সৌন্দর্জতত্বের শাশ্বত জায়গা থেকে। এটা ঠিক যে তিন জনই পুরুষ এবং প্রতীক, বয়ানের উপস্থাপনার দিক থেকে সুলতানের ক্যানভাস অপেক্ষাকৃত বেশি মাতৃ-তান্ত্রিক, যেখানে নারী এবং পুরুষের পেশলতা তাদের একটা সমীকৃত অবস্থানে এনেছে। এই পেশি আমি শামসুরের নাগরিক এবং মাহমুদের গ্রামীণ নাগরিক চরিত্রেও পাই।   

বাংলা নন্দনতত্ত্বের ধ্রুপদী ক্যাননদের পরম্পরা ধরে উত্তর পঞ্চাশ যদি একটি অভিভাবকীয় ক্যানোনিকাল সমবাহু ত্রিভুজ কল্পনা করা হয়, তাতে আমি কবি শামসুর রাহমান এবং কবি আল মাহমুদকে দুটি বাহু দেবো এবং তৃতীয় বাহুতে রাখবো চিত্রশিল্পী সুলতানকে। চিত্রকলার অনুশীলকেরা আমার এই ত্রিভুজের প্রতিশোধ-কল্পে চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ, ষড়ভুজ এনে কবিদের ভাগে কম দিয়ে চিত্রকরদের বেশি করে বসিয়ে দিতে পারেন, মায় বাঙালি কবিদের একটি বাহুও না দিতে পারেন, তাতে আমার প্রস্তাবিত নান্দনিক ক্যানোনিকাল ত্রিভুজের সমীকরণ বদলাবে না। বাঙালি নন্দনের ধ্রুপদী ক্যানোনিকাল কাঠামোতে গেলেও আমরা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাচ্ছি, শান্তিনিকেতনে যিনি একাধারে বাংলার প্রধান কলা চর্চা-কেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


দুজন কবিকে প্রধান বাহু করে একজন চিত্রকরকে তৃতীয় বাহুতে এনে আমার নান্দনিক ত্রিভুজটিকে অনেকের বেখাপ্পা লাগবে। বেখাপ্পাকে মাপসই করবার খেলাই নন্দনতত্ত্ব। গবেষক গোলাম মুর্শিদের মত আমি বলতে চাই না যে বাংলা সাহিত্যে যেরকম বিশ্ব মানের কাজ হয়েছে, বাংলার চিত্রশিল্পে সেরকম হয় নি। বরং আমি বলবো যে চিত্রশিল্পীরা অনেক রকম সামাজিক আনুকূল্য পাবার পরও সমষ্টিকভাবে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অন্তর্মুখী ক্রে তুলেছেন, বাংলার কবিরা যা করেননাই। জাতী হিশেবে বীক্ষণ, ঈক্ষণ, দর্পণের প্রিজম বাঙালি পেয়েছে তার কবিদের হাতে, আবার বিশ্বায়নেও পৌঁছেছে কবিদের হাত ধরে। শত দুতাবাসিয় এবং সরকারি আনুকূল্য পেয়েও চিত্রশিল্প তা করতে পারে নাই। কিন্তু তাহলে আমার নান্দনিক ত্রিভুজে সুলতানকে নিয়ে টানাটানি কেন? তাও আবার দুজন প্রধান কবির পাশে বাসিয়ে। কারণ সুলতানের ক্যানভাস একাই দুজন প্রধান কবির শাব্দিক জমিনের সাথে সম্পূরক হতে পারে। শামসুর রাহমানের আগাপাশ্তোলা নাগরিক আবহ, আল মাহমুদের গ্রামীণ নাগরিকতা কিম্বা নাগরিক গ্রামীণতার একটা সাঁকো হতে পারে সুলতানের ক্যানভাস।

কিছুকাল আগে তরঙ্গ ওয়েবজাইনে কনক রহমান সুলতানের চিত্রকলার অন্তস্থ এরোটিকার সাথে জাপানি উপন্যাসিক তানিজাকি এবং পিকাসোর জাপানি শুঙ্গা আর্ট সংগ্রহের বাতিকের একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। সাথে তারেক মাসুদের আরোপিত শ্রেণি সচেতনতা সুলতান অবলোকনকে কোথায়  সীমাবদ্ধ করেছিলো তার ওপর কনক আলোকপাত করেছিলেন। লেখাটি আমার খুবই ভালো লেগেছিলো। লেখাটি পড়বার সময় মনে হয়েছিলো সুলতান এবং আমাদের প্রধান সাহিত্যিকদের ভেতর মিশ্রকলার সম্পূরক এবং তুলনামূলক নান্দনিক আলোচনা হতে পারে। আমার বর্তমান লেখাটির দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই কনক রহমানের লেখাটির প্রতি ঋণী।

ফটোগ্রাফার নাসির আলী মামুন সুলতানকে নিয়ে অসামান্য এলবাম আমাদেরকে দিয়েছেন। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সুলতানকে নিয়ে বানিয়েছেন আদম সুরত। নাসির আলি মামুন অনেক কবিদের অনবদ্য পোট্রেট করলেও পুরো এলবাম করেছেন বলে আমার জানা নাই। তারেক মাসুদ সহ কোনো স্থানীয় চলচ্চিত্রকার কোনো প্রধান কবিদের নিয়ে কোনও বায়োপিক এখনো বানান নাই। যে পরিমাণ ধী, কারিগরি, প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের প্রধান কবিদের জীবনকে তুলে ধরা যাবে তা এখনো আমাদের চলচ্চিত্র অর্জন করে নাই। সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রের হাটি হাটি পা পা দেখলে তা বলা যায়। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা একজন বিশ্বজয়ী সাহিত্যিক হলেও দুই বাংলার শিল্প ঘরানাগুলোসাহিত্যের সাথে সম্পর্ক শূন্য। বিশ্বের শিল্পান্দোলনগুলোর বড় বড় ব্র্যান্ড নেম কিউবিজম, সুরিয়ালিজম যে একজন কবি আপোলিনেয়ারের কলম থেকে এসেছে তাই এখানকার শিল্প নবিশ এবং বোদ্ধারা জানে না।

শামসুর রাহমানের জন্ম পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে, বিকাশ এবং কর্মজীবন ঢাকায়। আল মাহমুদের জন্ম ব্রাক্ষনবাড়িয়াতে, বিকাশ এবং কর্মজীবন ঢাকাতে। বাংলা কবিতার এই দুই প্রধান কবির জীব্তকালীন তাদের কবিতা পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠের পাশাপাশি, ঢাকা এবং বৃহত্তর কুমিল্লা আমি বার বার চষে বেড়িয়েছি। একই সাথে শামসুর এবং মাহমুদের কাব্যিক পারস্পরিকতা যখন রাজনৈতিক বৈরিতায় গড়ায় তার সাংগঠনিক অভিক্ষেপটি দেখেছি একেবারে ভেতর থেকে। 

সামরিক স্বৈরতন্ত্রী জান্তা যখন কবিতা কেন্দ্র গঠন করে কবিদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলো তাতে প্রধান কবিদের ভেতর যোগদান করে আল মাহমুদ এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ। এই মঞ্চকে প্রত্যাখ্যান করে শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় কবিতা পরিষদ। মান্নান সৈয়দের পরামর্শে এবং নিজের ছাপাখানার ব্যাবসায়িক স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সত্তর দশকের অন্যতম কবি আবিদ আজাদ যোগ দেয় কবিতা কেন্দ্রে। এর সরাসরি প্রতিক্রিয়াতে প্রায় স্থায়ীভাবে আবিদ আজাদের সাথে কবি শিহাব সরকারের কিম্বদন্তীতুল্য হার্দিক সম্পর্কটি নষ্ট হয়ে যায়।

শিহাব সরকারের কাছে কবিতা পরিষদে যোগ দান ছিলো ওনার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অংশ, সেখান থেকে দেখলে আবিদ আজাদের পদক্ষেপটি ছিলো উভয়ত আত্মিক এবং নান্দনিক পতন। কবিতা পরিষদে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহন রায়হান, খোন্দকার আশরাফ হোসেন কারো কাছে আবিদ আজাদ প্রিয় পাত্র ছিলেন না। আশির অনুজ কবিদের কাছ থেকে এবং কাদরীর মত কবিদের কাছ থেকে আবিদ যে কবিদের কবি সমিহভাজন অভিধাটি সবে লাভ করছিলেন, ঐ পদক্ষেপে তা ধুলায় লুটিয়ে যায় এবং ঢাকার সব মঞ্চে গৌণ কবি এবং আবৃতিকারদেরর কথিত দ্রোহের কবিতা ভর করে ছড়াকারেরা ঢাকার সব মঞ্চ দখল করে ফেলেছিলো। জাতীয় কবিতা পরিষদের মূল কমিটিতে তাদের স্থান দেয়া না হলে জাতীয় ছড়াকার পরিষদ গঠন করা হবে বলে হুমকি দিলে ফয়েজ আহমেদের মধ্যস্থতায় এবং মোহন রায়হানের সুপারিশে লুতফর রহমান রিটন, আসলাম সানি, আমিরুল ইসলামকে জাতীয় কবিতা পরিষদের মূল কমিটিতে নেয়া হয়।

আশির যেসব কবি আবিদ আজাদ সম্পাদিত লিটেল ম্যাগ কবিতে অংশ নিতো তাদের ভেতর নিয়মিত ছিলো রিফাত চৌধুরী, কাজল শাহনেওয়াজ, আহমেদ মুজিব এবং আমি। কবিতা কেন্দ্রে যোগ দানের পর আবিদ আজাদ শুরু করেন শিল্পতরু পত্রিকা, তাতে আহমেদ মুজিব বাদে আমাদের কেউ আর অংশ নেয় নি। আহমেদ মুজিবের অংশ নেয়াটা ছিলো চাকুরীর শর্ত, কারণ সে ছিলো শিল্পতরু প্রেসের ম্যানেজার। একদিকে আবিদ আজাদ যেরকম তার প্রেসের কলেবর বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছিলো, আরেক দিকে সামরিক জান্তার বিরোধিতা করেও বিকল্প ঋণ প্রকল্পের বড় একটি ঋণ পান মোহন রায়হান। এসব ডামাডোলে আমাদের অনেক মেধাবী সতীর্থ হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত, যা সামরিক জান্তার জন্য ছিলো শাপে-বর। আবার কবিতাসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক মঞ্চে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ধান্দাবাজদের প্রাদুর্ভাব, যারা এই মঞ্চগুলোকে ব্যাবহার করতে থাকে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে ঠিকাদারির সোপান হিশেবে।

কাব্য ক্ষেত্রে যেরকম,  এই একমাত্রিক আন্দোলনের প্রভাবে চারুশিল্পেও দেখা দেয় কার্টুনের রমরমা। এসময় কিছু তরুণ কবি স্লোগানের গড্ডালিকা এবং পলায়নবাদের প্রহেলিকা থেকে সরে সমকালীন বয়ান এবং নান্দনিকতার শর্ত আদায় দুই দিকেই সচেতন হয়ে ওঠে, যাদের সমাবেশে পরে বের হয়ে আসে ফৃ স্কুল স্ট্রীট।

বরেণ্য শিল্পী কামরুল হাসান, রফিকুন্নবী আন্তরিকভাবে জড়িত ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাথে। কামরুল হাসানের মৃত্যুও ঘটে এ মঞ্চে। সুলতানের তখনকার ভূমিকাটি ছিলো অনেকটা  Far From The Maddening Crowd, একজন তপস্বী, মহাকাব্যিক ধৈর্যে যিনি তার পূর্ব পুরুষের পটভূমিকে পেশলভাবে উত্তরপুরুষের জন্য ধরে রাখছেন। জার্মান কালচারাল সেন্টারে তার একক প্রদর্শনী, আদম সুরতে তার জৈবনিক প্রামাণ্য চিত্রের প্রিমিয়ার কোনটাই মিডিয়া হটকেক হয়ে ওঠে নাই। এখন হলে কি হতো, তা ভিন্ন কথা। উনি তার নিজস্ব ধরনে ঐ পেশল অবয়বগুলো না আঁকলে হয়তো আমরা আবু জাফর ওবায়দুল্লার আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি, মোহাম্মদ রফিকের কীর্তিনাশা কবিতা পেতাম না। আমি যে বহু বছর পর প্রবাসে বসে বাঙ্গালির পরিচয় কাব্য লিখে তাকে আফরোজা জামিল কঙ্কা এবং প্রশান্ত মহারানার সহযোগিতায় তালপাতার পুথিতে রূপান্তর করেছি, তাতেও ঘুরে ফিরে এসেছে সুলতানের অন্তস্রোতা প্রভাব।

৪ 

আগে লিখেছি বিভিন্নভাবে শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদকে অনেক বার দেখবার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৮৮তে ঢাকায় প্রবল বন্যা হয়েছিলো। সারা দিন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বন্ধুদের সাথে নৌকায় ঘুরে ত্রাণ কাজ শেষে এক সন্ধ্যায় গেছি, আবিদ আজাদের কাঁঠাল বাগানস্থ শিল্পতরুর ডেরায়  ওখানকার ম্যানেজার বন্ধু আহমেদ মুজিব ওরফে কচির খোজে। কচি কোথায় য্যানো গিয়েছে, কিছুক্ষণ পর ফিরবে। ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ আরো কয়েকজন। আমি যে ঢাবিতে পড়ছি ওনারা সবাই জানেন, আরো জানেন যে প্রবল ভাবে আমি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এবং মিছিল, মিটিং এ সক্রিয়। মাহমুদ ভাই আমাকে দেখে বলে উঠলেন, 'ডাকাতদের গ্রামে আজকে কি ঘটছে?' এটা যে উনি ওনার কাব্য সতীর্থ এবং কাব্য হিংসার লক্ষ্যস্থল শামসুর রাহমানকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন বুঝতে অসুবিধে হয় নি। এই ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগতো যে ওনাদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা বোঝা যেতো, কূটনৈতিক ছলচাতুরী ছিলো না। লাইক, লাভ, যায়গা বুঝে নীরব, সরবের যুগে ওনারা বিপদে পড়ে যেতেন। বিপদে পড়তেন মাসিমদিয়ার লাল মিয়াও। বেজি, সাপ, পাখপাখালিসহ প্রায়ই যে বাঁশি বাজানো, আলখিল্লা পরা সুলতান ভাইরাল হতেন তা লেখা বাহুল্য।

সুলতানের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো ১৯৯১ সালে ঢাকা বিমান বন্দরের আভ্যন্তরীণ ভবনে। আমি তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের দাদুরি করি। তার একটা কাজ ছিলো প্রতিদিন সকালে আভ্যন্তরীণ ভবনে গিয়ে সিলেট থেকে আগত যাত্রীদের যারা বিকেলে লন্ডনে যাবে তাদের ঢাকার পাঁচ তারা হোটেলে পাঠানো। এসব হট্টগোলের ভেতর দেখি এক কোনায় সুলতান বসে আছেন। পাশে আটপৌরে ঢংতে কালো চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি পরা শ্যামলা একহারা একজন মাঝবয়সী নারী সযত্নে সুলতানের তেল জবজবে ঘাড় ছাড়ানো চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন। সুলতানের পরনে সেই কালো কম্বলের জোব্বা। দেখে হাসিমুখে বললাম, কেমন আছেন, 'একটু আপনাদের সাথে বসতে পারি?' সুলতান মৃদু হেসে ভাঙ্গা চোয়ালে বসানো মোটা ডাটির কালো চশমার আড়ালে চোখ উঁচিয়ে বললেন, 'বসো'। আমার পরনে ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের পোশাক, হাতে ওয়াকিটকি, আমি যেরকম ঢ্যাঙ্গা লম্বা তাতে ইউনিফর্মকে মনে হতে পারতো হ্যাঙ্গারে ঝোলানো এবং আমারো সুলতানের চ্চিত্রচরিত্রদের মতো পেশির দরকার। এটা ওটা বলে বুঝলাম যে ওনাদের যশোরগামি প্লেন উড়তে দেরি হচ্ছে, তার পর বাতিল হয়েছে এবং পরের ফ্লাইটের যাত্রীরা এসে পড়েছে, ওনাদের ফ্লাইট আবার কখন কেউ বলতে পারছিলো না। কারো হাতেই তো মোবাইল ইত্যাদি নেই। সম্ভবত বেঙ্গলের লোকজন সুলতানকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো, তারাও জানে না যে ওনার ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। বিমানের একজনকে বলে ওনার থেকে নাম্বার নিয়ে কাকে ফোন করেছিলাম ঠিক মনে নেই। তারা এসে ওনাদের নিয়ে গেলো। আমার নিজের এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের হজপজের ভেতর ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার মত একজনকে আপনি কি পরামর্শ দেবেন? সুলতান বলেছিলেন, 'ঘুরে বেড়াও!'


ঘুরতে ঘুরতে এবার যাচ্ছি মাসিমদিয়া! 


চয়ন খায়রুল হাবিব

১৫/৭/২৪

ঢাকা 


*ওয়াইকিপিডিয়া

ছবি : সুলতানের আঁকা আদম সুরাত